ডেস্ক নিউজ
চলতি মৌসুমে সুমিষ্ট আমরাজ্য হিসেবে খ্যাত রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে অন্তত ১১ কোটি আম নিরাপদ ও বিষমুক্ত করা হবে। ফ্রুট ব্যাগিংয়ের মাধ্যমে ইতোমধ্যে দুই জেলার চাষী ও ব্যবসায়ীরা নিরাপদ আম উৎপাদনের কার্যক্রম শুরু করেছে। নিরাপদ আম উৎপাদন ছাড়াও আমের বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি, কীটনাশক প্রয়োগে খরচ কমানো ও বিদেশে রফতানিযোগ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে উত্তরের দুই জেলায় বাড়ছে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ব্যবহার।
শতভাগ নিরাপদ আম উৎপাদনের উপায় হওয়ায় কয়েক বছর ধরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ফ্রুট ব্যাগিং। এবার শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জেই প্রায় ১০ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া রাজশাহীতে আরও এক কোটি আমে ব্যবহার করা হবে ফ্রুট ব্যাগিং। তবে আমচাষীদের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি ও নিম্নমানের ফ্রুট ব্যাগ সরবরাহ করার অভিযোগ কৃষকদের। চলতি মৌসুমেও মানসম্মত ব্যাগ না পাওয়ায় চাহিদামতো আমে ব্যাগিং করতে পারছেন না চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকরা।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে আম উৎপাদন, পরিচর্যা ও বাজারজাত করতে হচ্ছে দুই জেলার আমচাষীদের। বাম্পার ফলনেও আশাবাদী হতে পারেন না কৃষকরা। তবে গত কয়েক বছরে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পোকামাকড় দমনে কীটনাশকের মাধ্যমে পরিচর্যার বিকল্প হিসেবে দেশের বাজারে এ পদ্ধতির আম চাহিদা থাকায় বিক্রি বাড়ে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় এ পদ্ধতির প্রধান উপকরণ ফ্রুট ব্যাগ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ব্যাগের সিংগভাগই চীন থেকে আমদানি হওয়ায় মূলত এ বছর ব্যাগের সঙ্কট দেখা দেয়। এতে করে অনেক আম চাষী নিরাপদ আম উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছেন। আবার এ সুযোগে অনেকে ব্যাগের দাম বাড়িয়ে কৃষকদের সমস্যায় ফেলেছেন।
চলতি বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিপিস ফ্রুট ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত। অভিযোগ উঠেছে, আমচাষীদের চাহিদাকে পুঁজি করে নিম্নমানের ফ্রুট ব্যাগ বাজারজাত করে সাধারণ কৃষককে ঠকাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাই কৃষকদের দাবি, ফ্রুট ব্যাগ ও তার কাঁচামালকে প্রকৃত কৃষিজাত পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে অধিক হারে বাজার মনিটরিং করার। এতে একদিকে যেমন নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত সম্ভব হবে, অন্যদিকে লাভবান হবে আমচাষী, ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌডালার একটি আমবাগানে দেখা যায়, ১৫/১৬ জনের একটি দল ব্যস্ত সময় পার করছে আমে ফ্রুট ব্যাগিং করতে। বাগান মালিক আব্দুল কাদের জানান, এবার ১০ বিঘার একটি বাগান নিয়েছি। ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, ক্ষীরসাপাত জাতের আম রয়েছে বাগানে। এসব আমে গত ৩ দিন থেকে ফ্রুট ব্যাগিং করছি। এতে আমে কোন দাগ থাকে না, বিষ দিতে হয় না, আমের কালারও খুব ভাল আসে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই স্থানীয় দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাকিব আলী ফ্রুট ব্যাগিং করার কাজ করছে। সাকিব জানায়, বড় মই ও গাছের ডালে উঠে সব আমে ব্যাগ পরিয়ে দিচ্ছি। এতে সামান্য কিছু আম ঝরে পড়লেও এটি অত্যন্ত লাভজনক; তাই অনেক বাগান মালিক করে থাকে। এই কাজ বাবদ প্রতিদিন ১৫০ টাকা মজুরি পায় সাকিব।
আমচাষী ও ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো’ ব্যবস্থাপক শহিদুল হক হায়দারী জানান, গতবছরের মতো এ বছরও আমচাষীদের চাহিদাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়েছে। জেলার বেশিরভাগ আমচাষী অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত হওয়ায় তারা মানসম্মত ফ্রুট ব্যাগ চেনেন না। সেই সুযোগে মানহীন, অকার্যকর ফ্রুট ব্যাগ বাজারজাত করে এসব অসাধু ব্যবসায়ী। তিনি আরও বলেন, শিবগঞ্জ উপজেলায় গতবছর ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে এমন অনেক আমে এর কোন প্রভাব পড়েনি। অর্থাৎ মানসম্মত না হওয়ায় ব্যাগিং করা ও না করা আমের মধ্যে তেমন পার্থক্য দেখা যায়নি। বাজার মনিটরিং বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক ও আম রফতানিকারক ইসমাঈল খান শামিম জানান, ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম বিদেশে রফতানিযোগ্য ও শতভাগ নিরাপদ। কিন্তু বাজারে থাকা মানহীন ব্যাগের কারণে তা সম্ভব হয় না। ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি চালুর পর আমের ওজন ১০০ গ্রাম হলেই আমে ব্যাগ পরানো হয়। এতে করে কৃষক অন্তত ১০ বার কীটনাশক প্রয়োগের হাত থেকে রক্ষা পায়। এছাড়াও ব্যাগিং করা আম আকর্ষণীয়, দাগহীন ও পুরোপুরি কীটনাশকমুক্ত হয়। তাই আমচাষী, ব্যবসায়ী, রফতানিকারক ও ভোক্তার স্বার্থে ফ্রুট ব্যাগিংকে কৃষিপণ্য ঘোষণা করার দাবি জানান তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব আম গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলী জানান, আমের ওজন ৬০-১০০ গ্রাম হলো ফ্রুট ব্যাগ করার উপযুক্ত সময়। এতে ব্যাগিং করা আমটি অধিক পরিমাণে হলুদ রং ধারণ করে। তবে আম ফ্রেশ রাখতে চাইলে ৫০ গ্রাম ওজনের সময় ফ্রুট ব্যাগিং করতে হবে
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও জানান, আম পরিপক্ক হওয়ার আগে-পরে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হলে আমের গায়ে ছত্রাক দেখা দেয়। ফ্রুট ব্যাগিং করলে তা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ ধরনের কাগজের এই ব্যাগে দুটি আস্তরণ রয়েছে। বাইরের আস্তরণটি বাদামি রঙের, আর ভেতরেরটি কালো রঙের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ড. বিমল কুমার প্রামানিক বলেন, গতবছর জেলায় সাড়ে ৭ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়। এবছর তার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে কৃষি বিভাগ। ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ফলে আমের বাহ্যিক রং খুব আকর্ষণীয় হয়। এতে ক্রেতা আকৃষ্ট হয়। এছাড়াও শতভাগ নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচ উপজেলায় এবছর প্রায় ৩৪ হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে আমবাগান রয়েছে। এসব আম বাগানে প্রায় ২৭ লাখ গাছ থেকে আড়াই লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
এদিকে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহকারী উপ-পরিচালক তৌফিকুর রহমান জানিয়েছেন, এবার এ অঞ্চলের আম জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও সুইজারল্যান্ডে যাবে। রাজশাহীর ক্ষীরশাপাত, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও তোতাপুড়ি আম যাবে ইউরোপে। তবে সরকারীভাবে নয়, বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস এ্যান্ড এ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার এ্যাসোসিয়েশন আম রফতানি করবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজশাহীর প্রায় ৩৫.৭৫ মেট্রিক টন আম রফতানি হয়েছিল। এরমধ্যে গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাত, আম্রপালি, হিমসাগর ছিল।
করোনার কারণে গেল বছর রাজশাহী থেকে কোন আম সরকারীভাবে রফতানি হয়নি। তবে বাঘা থেকে ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস এ্যান্ড এ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার এ্যাসোসিয়েশন বেসরকারী ৯ মেট্রিক টন এবং অন্যান্য উপজেলা থেকে ১২ মেট্রিক টন আম রফতানি করে।
তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে রাজশাহীর আমের প্রচুর চাহিদা ও সুনাম রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে রাজশাহীর আম চাষী ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বাইরে আম রফতানি করতে না পারায়। তবে এবার ৩৩৩ মেট্রিক টন আম রফতানির টার্গেট নেয়া রয়েছে। রফতানি ক্ষেত্রে ভাল সুবিধা পেলে আরও বেশি রফতানি করা হবে।