ডেস্ক নিউজ
করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবী আজ এক কঠিন সময় পার করছে। মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ে সমস্ত পৃথিবীর চেহারা পাল্টে গেলো ! সমগ্র জগতের নগর থেকে নগরে আজ লকডাউন ! বন্ধ হয়ে গেছে জাগতিক সব ঘূর্ণন গতি; কলকারখানা, ইঞ্জিত, স্থল-আকাশ কিংবা জলের সব যানের গতি, থেমে গেছে মানুষের আনাগোনা, অর্থনীতির চঞ্চলতা। মানুষ ফিরে গেছে সেই আদিম জীবনে ! মনে হচ্ছে এক রূপকথার সময় অতিক্রম করছে আজ বিশ্ব, মনে হচ্ছে মানুষ দেখছে সায়েন্স ফিকশনের কোন সিনেমা।
বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরের কোন দেশ নয়। তাই আমাদেরও আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের দৃষ্টি হলো রাজনৈতিক। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রাজনীতি সচেতন জাতি। করোনাও আমাদেরকে রাজনীতি বিমুখ করতে পারেনি। আমাদের সরকারগুলো যেমন রাজনৈতিকভাবে প্রতিটি ঘটনাকে দেখে, আমাদের বিরোধীদলগুলোও তেমনি দেখে। রাজনীতির কারণেই আমাদের সরকার ঘোষিত করোনা রোগীর হিসাব অনেকে বিশ্বাস করেন না।
অনেকে পরিহাস করে বলতেছেন,–আমাদের দেশে টেস্ট নেই, তাই করোনার রোগীও নেই। এটি অবশ্য সত্য,– সক্ষমতার সত্য। আরো বেশি সত্য হলো, এ মূহুর্তে সমস্ত পৃথিবীর সবারে যদি পরীক্ষা করা যেতো, তবে করোনার রোগী হতো কয়েক কোটি। কিন্তু বিশ্ব বলছে, এ পর্যন্ত রোগী হলো প্রায় সোয়া সাত লাখ !
বাস্তবতা হলো, শুধু ইতালির ছয় কোটি নাগরিককে একদিনে টেস্ট করলেও রোগী হবে এক কোটির বেশি। কিন্তু এত বেশি মানুষের একত্রে টেস্ট করার সক্ষমতা সমস্ত বিশ্বেরই নেই এ মূহুর্তে। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত রেকর্ড হলো, এক সপ্তাহে ১৬ লাখ মানুষের করোনা টেস্টের রেকর্ড,– যা করেছিলো চীন। এবং সে জন্যেই চীনকে পশ্চিমারা সন্দেহ করে !
পশ্চিমারা সন্দেহ করে;– কেন চীন আগে থেকে এত কিট তৈরি করে রাখলো। কেন তারা এতবেশি ইনফ্রাস্ট্রাকচার আর লজিস্ট্রিক সাপোর্ট রাখলো যে, সপ্তাহে লাখ কোটি মানুষের জন্যে অগণিত অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করে ফেললো, লাখ লাখ মানুষকে সুস্থ্য করে তুললো আর মাস দু’য়েকের ভিতরে সবারে সুস্থ করে দিয়ে হাসিমুখে ডাক্তারেরা ঘরে ফিরে গেলো।
তারা আরো সন্দেহ করছে;– কিভাবে চায়না নতুন ঘরোয়া আক্রান্তের সংখ্যা জিরোতে নিয়ে এলো কিংবা কিভাবে তারা বড়াই করে বলতে পারলো, তাদের কমিউনিস্ট নীতির কারণেই তারা তা’ করতে পেরেছে এবং ইউরোপ-আমেরিকা না পারার কারণ হলো তাদের গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফলে !
আগে যেখানে বিশ্বের সংকটে পশ্চিমারা সাহায্যের জন্যে সবার আগে হাজির হতো, এখন হচ্ছেন চীন। পশ্চিমারা কিভাবে সাহায্য করবে, তারাতো নিজেরাইতো ধ্বসে যাচ্ছেন। তাদের স্টক মার্কেটগুলো পড়ে যাচ্ছে আর চায়নারা সেসব শেয়ারগুলো অনবরত কিনতেছেন। তারা সাহায্য নিচ্ছেন আর চায়নারা সাহায্য করতেছেন। এসব হলো পশ্চিমাদের প্রশ্ন এবং সংশয়। এসব আমাদেরও প্রশ্ন এবং এসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয় আমরা পাবো। আমরা পশ্চিমাদের হতাশার গল্পগুলো পড়তেছি আবার চাইনিজদের বিজয়ের গল্পগুলোও পড়তেছি।
বিশ্ব আসলেই আজ এক বিস্ময়কর অবস্থানে এসে থেমেছে। এই বৈশ্বিক সমস্যাতে বাংলাদেশের কোন হাত নেই। এখানে ব্যর্থতা-সফলতায়ও আমাদের তেমন কোন অবদান নেই। তাই বাংলাদেশে রোগী বেড়ে গেলেও সরকারের কোন বদনাম নেই আবার কম হলেও সরকারের তেমন কোন সফলতা নেই। এবং শেষ কথা হলো, এই রোগের এখন পর্যন্ত কোন চিকিৎসা নেই। এই্ রোগের রোগী বাঁচবে তার নিজস্ব শারীরিক, মানসিক সক্ষমতার উপরে এবং সচেতনতার উপরে। তাহলে সরকার কেন রোগী কম দেখাবে !
বাস্তবতা মানলে আর ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা বিবেচনাতে নিলে, আসলে এক্ষেত্রে আমাদের কোন সক্ষমতাই নেই; না চিকিৎসাতে, না টেস্টে। তবে মানতে হবে, এবারই সরকার সময় মত প্রতিটি পদক্ষেপ রেসপন্স করেছেন। সরকার সময় মতো পাবলিক গ্যাদানিং অফ করেছেন, বিমান বন্দরে চেকসিস্টেম কঠোর করেছেন, সরকারী-বেসরকারী অফিসগুলো বন্ধ করেছেন, সেনাবাহিনীসহ দেশের সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নিয়েছেন, আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ বন্ধ করেছেন। সে জন্যে আমরা সুফলও পেয়েছি।
সে জন্যই বলছি, আসলেই বাংলাদেশে করোনার রোগী কম এবং এটি সত্যও। বাংলাদেশ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মতামত প্রকাশের দেশগুলোর একটি। এদেশে প্রায় দশকোটি মানুষ ফেজবুক টাইটারসহ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। হিসেবে এরা সবাই নাগরিক সাংবাদিক। এদেশে এ মূহুর্তে কোন বাসাতে একটি মানুষ অকালে মারা গেলে দশ মিনিটের মধ্যে সে খবর চলে আসবে ফেজবুকে এবং ঘন্টা খানেকের ভিতরে সে পরিবারকে ঘেরাও করা হবে, এটি প্রায় নিশ্চিত। আমরা দেখতেছি, অনেক সাধারণ সর্দি-কাশির রোগীকেও করোনা রোগী বলে অনেকে প্রচার করতেছেন, অবশ্য উল্টো খবরও বহু আসতেছে।
ইতালিতে মানুষ আছে প্রায় ছয় কোটি আর বাংলাদেশে মানুষ হলো তার প্রায় তিন গুণ। ইতালির হিসেবে আমাদের দেশ আক্রান্ত হলে মানুষ মারা যেতো প্রতিদিন তিন হাজার আর তাদের তুলনায় আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা দুর্বল বলে তা হতো পঞ্চাশ হাজার। সেসব বাদ যাক, সারাদেশে গোটা পঞ্চাশেক অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে আমাদের সংবাদপত্র আর সামাজিক মাধ্যমের অবস্থা কেমন হতো ! তোলপাড় হয়ে যেতো। সরকার কি আসলেই এত খবর লুকোতে পারতো ! পারতোনা।
বাস্তবতা হলো, আমাদের অবস্থা সে রকম নয়। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ প্রথম ধরা পড়ে উহানে, যা ইতালি থেকে আমাদের অনেক অনেক বেশি নিকটের। তাছাড়া চীনের সাথে আমাদের ছিলো বেপরোয়া যোগাযোগ এবং মেলামেশা। আমাদের যদি কিছু হতো, তবে আজকের ইতালির যে অবস্থা তা আমাদের দেশে হতো দুই মাস আগে থেকে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের অবস্থা এখনো তত খারাপ নয়।
বিশ্বের অনেক মনীষী,–শীত-গরম, আবহাওয়া-জলবায়ু, অক্ষাংশ-দ্রাগিমাংশ ইত্যাদি হিসাব দিয়ে বুঝাতে চাচ্ছেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো গরমের কারণে বেঁচে আছে এখনো। আবার অনেক মনীষী হিসাব করে দেখিয়েছেন, পুরো বিশ্বের প্রায় ডজন খানেকের মতো দেশ করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত আজ। সেসব দেশ যেসব মহাদেশে আছে সেসব মহাদেশের অন্য গরীব দেশগুলোও ঐ একই আবহাওয়াতে বিরাজমান। কিন্তু ধরা পড়েছেন তারাই যারা বৈশ্বিক রাজনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রণে নেতৃত্ব দেন।
তাঁরা স্মরণ করে দিয়েছেন, বহু দশক পর চীনের পলিটব্যুরো পরিবর্তনের কথা, চীন কর্তৃক বিশ্বের একেশ্বরবাদী প্রধান ধর্মগুলোর সমালোচনার কথা,–কোরআন, বাইবেল পরিবর্তন করে তাদের কমিউনিস্ট তরিকায় লিখার কথা, তাদের স্টাইলে একটি বিশ্বব্যাংক গড়ার কথা এবং তাদের “ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট” নীতির কথা। মনীষীরা মিলিয়ে দেখিয়েছেন, পৃথিবীর সব ধর্মকেন্দ্র আজ অফ—মানে বিশ্বাসের গোড়ায় আঘাত করা হয়েছে। তাঁরা দেখিয়েছেন ন্যাটোর নেতারা আজ দিশেহারা,– মানে শক্তির ভরকেন্দ্র আজ পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে।
যাই হোক, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ গণচীনের ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৩৪ টি প্রদেশ রয়েছে এবং তাদের সীমান্তে রয়েছে চৌদ্দটি দেশ, যার ভিতরে ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতও একটি। এই সব এত এত দেশ-দুনিয়া ছেড়ে করোনাভাইরাস বহুদূরের ইউরোপে গিয়ে আছড়ে পড়েছে আর পড়েছে আমেরিকার পঞ্চাশটি রাজ্যে প্রায় একসাথে ! এসব হলো, পশ্চিমাদের হিসাব। আর আমাদের হিসাব ! আমরা হলাম বিজ্ঞানের থেকে আধ্যাত্মিকতায় এগিয়ে থাকা জাতি। তাই আমাদেরকে চলতে হয় বিশ্বাস নিয়ে।
আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে;- হয় মহান আল্লাহ তা-আলা আমাদেরকে তাঁর কুদরতি হাতে রক্ষা করতেছেন, নতুবা এখানে একটি গেইম থিউরি বিদ্যমান, যে থিউরি থেকে আমাদের সরকার আমাদেরকে এ পর্যন্ত রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে যাই হোক না কেন, আমরা বিপদ-জোনের বাইরেই আছি। আমাদের বাতাসে কোন ঘৃণার জীবাণু নেই, থাকলে বহু আগেই আমাদের সবিনা খতম হয়ে যেতো।
আমাদের আপাতত একমাত্র ভয় হলো বিদেশ থেকে আগত আক্রান্ত রোগীদের দিক থেকে। তাই আমাদেরকে অন্তত আরো তিন সপ্তাহ বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে, ঘরে থাকতে হবে, কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকার ঘোষিত ‘স্থাস্থ্য বিধিগুলো’ মেনে চলতে হবে, অপ্রয়োজনে বের হওয়া পরিহার করতে হবে, যথা সম্ভব স্পর্শ ত্যাগ করতে হবে, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। এটি আমাদের করতেই হবে, কারণ এক্ষেত্রে আর কোন প্ল্যান ‘বি’ নেই।
এটি নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের আর ভয় নেই। আর যদি আমরা তা না মানি, তবে বিপদের মাঠে না থেকেও আমরা বনের কচু শরীরে লাগিয়ে বিপদে পড়ে যাবো। আল্লাহ আমাদের বুঝারো তওফিক দান করুক।
গোলাম সারোয়ার, গবেষক ও কলামিস্ট।