ডেস্ক নিউজ
সাভারে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাচার চক্রের খপ্পরে পড়েছিলাম। এ ঘটনায় আমার ভাই বাদী হয়ে মামলা করেন। ঘটনার কয়েকদিন পর পুলিশ আসামিদের নীলফামারী থেকে গ্রেফতার করে। পাশাপাশি আমাকে উদ্ধার করা হয়। এ মামলার সাক্ষী হিসাবে আমার নামে সমন জারি হয়। কিন্তু আদালত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকায় আমি ভীত হয়ে পড়ি। কয়েকদিন আগে ভাইকে নিয়ে আমি ঢাকা মহানগর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যাই।
আদালত প্রাঙ্গণে আমার চোখে পড়ে পুলিশের সাক্ষী সহায়তা কেন্দ্র। সেখানে যাওয়ার পর দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর আদালত সম্পর্কে আমার ভীতি কেটে যায়। এরপর আদালতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যে ও সাহসের সঙ্গে সাক্ষ্য দেই। সোমবার যুগান্তরকে মানিকগঞ্জের ঘিওর থানা এলাকার কল্পনা আক্তার (ছদ্মনাম) মোবাইল ফোনে কথাগুলো বলেন।
মুন্সীগঞ্জ সদরের দক্ষিণ ইসলামপুর গ্রামের শাহীন যুগান্তরকে বলেন, একটি মাদক মামলার সাক্ষী ছিলাম আমি। এর আগে মামলার সঙ্গে আমি সংশ্লিষ্ট ছিলাম না। হঠাৎ করে আমার কাছে ফোন আসে। বলা হয়- আদালতে সাক্ষ্য দিতে হবে। এতে আমি অনেকটা ভয় পেয়ে যাই। আদালত সম্পর্কে আমার ধারণা না থাকায় আমি পুলিশের সাক্ষী সহায়তা সেলে যাই। সেখানে যাওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা আমাকে সহজ ও সুন্দরভাবে ব্রিফ করেন। এরপর সংশ্লিষ্ট আদালতে আমাকে নিয়ে যান এবং আইনজীবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। অনেকটা সাবলীলভাবে আমি বিচারকের সামনে সাক্ষ্য দেই। সাক্ষী সহায়তা সেলের সহযোগিতা না পেলে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া সম্ভব ছিল না।
শুধু এ দুজনকে নয় অসংখ্য বাদী, চক্রান্তের শিকার ব্যক্তি (ভিকটিম) এবং সাক্ষীদের সহযোগিতা করছে পুলিশ। এটি পুলিশের নতুন উদ্যোগ। সম্প্রতি ১৩টি জেলার আদালতে বাদী, ভিকটিম ও সাক্ষী সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলায় এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১২ হাজার ৫৫৪ জনকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এ সেলের মাধ্যমে শরীয়তপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে। এ জেলায় ছয় হাজার ৪৩৬ জনকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মুন্সীগঞ্জে তিন হাজার ২২০ জন এবং ফরিদপুরে দুই হাজার ২০৩ জনকে সেবা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, অপরাধ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই সাক্ষীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ট্রাভেলিং অ্যালাউন্স (টিএ) এবং ডেইলি অ্যালাউন্সের (ডিএ) ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু বাস্তবে সাক্ষীরা টিএ-ডিএ পান না। বরং তারা নানা অবহেলা ও হয়রানির শিকার হন। আদালতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সাধারণ সাক্ষীরা সংশ্লিষ্ট আদালত খুঁজে পান না। পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এবং সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটররা (এপিপি) ঠিকমতো সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপনও করেন না। বিশেষ কারণে সাক্ষী হাজির না করে উভয়পক্ষের আইনজীবীরা মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত করেন। সাক্ষীদের সমন দেওয়া হলে অনেক সময় আসামি পক্ষ থেকে তা গায়েব করে দেওয়া হয়। এছাড়া সাধারণ সাক্ষীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে প্রায় অনীহা প্রকাশ করেন। এতে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। একপর্যায়ে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাবে ঝুলে থাকা মামলায় অপরাধীরা খালাস পেয়ে যায়। এ কারণে সাক্ষীদের সুরক্ষা ও সহায়তা দিতে পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ময়মনসিংহের পিপি (নারী ও শিশু) অ্যাডভোকেট বদর উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখানে এ ধরনের কোনো সহায়তা কেন্দ্র নেই। এটা হলে অনেক ভুক্তভোগী উপকৃত হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মুক্তাগাছার গাড়াইকুটি গ্রামের চামেলী আক্তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এপ্রিলে ঈশ্বরগঞ্জের সরিষা গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে তাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এখন চামেলী বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কিছুদিন পর চামেলীর বাবা ও দুই ভাইয়ের নামে সমন আসে। এতে বলা হয়- চামেলীকে তার বাবা ও দুই ভাই আটকে রেখেছেন।
এছাড়া চামেলী তার স্বামীর বাড়ি থেকে ৮০ হাজার টাকা চুরি করে পালিয়েছে। মামলায় এক নম্বর সাক্ষী করা হয় চামেলীকে। ওই সমন পেয়ে চামেলীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। এরপর তিনি ঈশ্বরগঞ্জ থানায় যোগাযোগ করেন। স্বামীসহ নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে তাকে মামলা করার পরামর্শ দেয় পুলিশ। চামেলীর করা মামলায় ১৮ সেপ্টেম্বর আদালতে জামিন নিতে যান তার স্বামী শফিকুল ইসলাম। তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। তিনি এখন ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
পিপি বদর উদ্দিন আরও বলেন, চামেলী চার সন্তানের জননী। এ মুহূর্তে ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এখন তার সংসার ভাঙার উপক্রম। আদালতে ভিকটিম সহায়তা কেন্দ্র থাকলে চামেলী সহজেই প্রতিকার পেতেন। সমনের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির হলে তার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তিনি বলেন, শুধু চামেলী নয়, তার মতো আরও অনেক ভুক্তভোগী আছেন ময়মনসিংহে।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জিহাদুল কবির (প্রশাসন) যুগান্তরকে বলেন, এপ্রিলে সাক্ষী সহায়তা কেন্দ্র গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ঢাকা রেঞ্জের সব জেলায় এ সহায়তা কেন্দ্র গঠন করা হয়েছে।
তথ্যানুযায়ী- ২৫ মে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ১৩টি জেলার এসপিকে চিঠি দেন। জেলাগুলো হলো- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও মাদারীপুর। চিঠিতে বলা হয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আদালতে যেসব সাক্ষী আসেন তাদের কোনো বিশ্রামাগার বা ওয়েটিং রুম নেই। সাক্ষ্য গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ের সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করা হয় না। তাই আপনার জেলায় জেলা ও দায়রা জজ এবং সিজিএম আদালতের সঙ্গে আলোচনা করে আদালতে সাক্ষীর জন্য বিশ্রামাগার স্থাপন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি তাদের সাক্ষ্য দিতে সহায়তা ও সাক্ষী হাজিরা গ্রহণ সংক্রান্ত সাক্ষী সহায়তা কেন্দ্র গঠন করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ওই চিঠির পর ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট সব জেলায় সাক্ষী সহায়তা কেন্দ্র গঠন করা হয়েছে।
ঢাকা রেঞ্জের অপর অতিরিক্ত ডিআইজি নূরে আলম মিনা যুগান্তরকে বলেন, জেলা ও দায়রা জজ এবং সিজিএমের সব বিচারিক আদালতের সঙ্গে কাজ করছে সাক্ষী সহায়তা কেন্দ্র। আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই যাতে সাক্ষী সহায়তা সেলের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে এমন জায়গায় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জের সাক্ষী সহায়তা সেলের ইনচার্জ আনিসুর রহমান বলেন, নতুন এ উদ্যোগে আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আমাদের কাছে প্রতিদিন সেবাপ্রত্যাশীরা আসছেন। সেবা পেয়ে সাক্ষী, বাদী ও ভিকটিমরা খুব খুশি। কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পেয়ে আমরাও আত্মতৃপ্তি অনুভব করছি।
গাজীপুরের কোর্ট ইন্সপেক্টর মারুফ হোসেন বলেন, সাক্ষী ছাড়াও অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীরা ২২ ধারায় জবানবন্দি দিতে আমাদের কাছে আসছেন। অনেকে সমন দেখিয়ে বলেন, এ আদালতটি কোথায়? আমরা তাদের আদালতে পৌঁছে দিচ্ছি। আইনজীবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। বাদী ও সাক্ষীরা যাতে আদালতে দাঁড়াতে ভয় না পান সে বিষয়ে আমরা দিকনির্দেশনা দিচ্ছি। আদালতের কাজ শেষে তারা আমাদের ধন্যবাদ দিয়ে যাচ্ছেন। কাজ করতে আমরা ব্যাপক উৎসাহ পাচ্ছি।