উন্নয়ন প্রকল্পে দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানোই যেন নিয়ম। বিশেষত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে তিন থেকে চার গুণ ব্যয় বাড়ানোর নজির রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এই অস্বস্তির মধ্যে বিরল ব্যতিক্রম গড়তে যাচ্ছে ‘দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা, গোমতী সেতু’ প্রকল্প। আট হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পে খরচ হতে যাচ্ছে সাত হাজার ২২ কোটি টাকা। প্রাক্কলনের চেয়ে ব্যয় কমেছে এক হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করে তিন সেতুর নির্মাণ ব্যয় কমানোর এ প্রস্তাব পরবর্তী একনেক সভায় উঠবে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি, শেষ কবে একনেক সভা প্রকল্প ব্যয় কমানোর অনুমোদন দিয়েছে। সাধারণত সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের জন্য উত্থাপন মানেই ব্যয় বাড়ানো। কখনও খরচ বাড়ানো হয় বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণ দেখিয়ে কিংবা কখনও নতুন কাজ যোগ করে। অথচ ‘দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা, গোমতী সেতু’ প্রকল্পে নতুন কাজ যোগ হলেও খরচ বাড়ছে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণে কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতীতে পুরোনো সেতুর পাশে নতুন তিন সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পুরোনো তিন সেতুও মেরামত করা হয়েছে। এ প্রকল্পে তিন মাস সময় বাড়ছে। আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্প চলবে। প্রকল্প পরিচালক আবু সালেহ মো. নুরুজ্জামান সমকালকে বলেছেন, নবনির্মিত তিন সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ২০১৯ সালের মে মাসে। এতদিন ধরে আনুষঙ্গিক কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্প অনুমোদনের পর দরপত্র আহ্বানে দেরি হয়েছিল। এ কারণে প্রকল্প শেষে দুই বছরের ‘লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ ঠিক রাখতে তিন মাস সময় বাড়ানো হচ্ছে। আগামী জুনে প্রকল্প বুঝিয়ে দেওয়ার পর সংযোগ সড়কে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা বাড়তি সময়ে ঠিক করা হবে। অবশ্য আশাবাদী, ভবিষ্যতেও কোনো সমস্যা দেখা দেবে না।
সংশ্নিষ্টরা জানান, প্রকল্পের কাজ ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। তবে শেষ সময়ে নতুন করে ১১টি খাত যুক্ত করতে ৫০৯ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব অনুমোদিত হলে শেষ পর্যন্ত সাশ্রয় হবে ৯৫০ কোটি টাকার মতো। প্রকল্পে জাইকার ছয় হাজার ৪২৯ কোটি ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। প্রকল্প ব্যয় কমায় ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। সরকারি ব্যয়ও কমেছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। প্রকল্পে সরকারের জোগান দেওয়ার কথা ছিল দুই হাজার ৫৭ কোটি টাকা। ব্যয় কমায় তা কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩০৯ কোটি টাকা।
প্রকল্পের নথিপত্র থেকে জানা গেছে, প্রায় পৌনে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন তিন সেতুর সুপারস্ট্রাকচার নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ১৫২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা কম খরচ হয়েছে। পুরোনো তিন সেতুর সুপারস্ট্রাকচার পুনর্বাসনে ১৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা কম লেগেছে। সবচেয়ে বেশি সাশ্রয় হয়েছে পুরোনো তিন সেতুর সাব-স্ট্রাকচার মেরামতে। এতে প্রাক্কলনের চেয়ে এক হাজার ৪১৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা কম খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচটি খাতে পরিকল্পনার চেয়ে দুই হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা কম লেগেছে।
প্রাক্কলনের চেয়ে পাঁচটি খাতে এক হাজার ৪২১ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়েছে। নতুন তিন সেতুর সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণে ৮৫৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ১৩ কিলোমিটার সড়কের পেভমেন্টে ২৩৩ কোটি টাকা এবং বিবিধ খাতে ২৭৭ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়েছে প্রাক্কলনের চেয়ে। প্রকল্পে ১১টি নতুন খাত যোগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নিরাপত্তা খাতে ৭২ কোটি ৭৮ লাখ, পরিষেবা স্থানান্তরে ১৩ কোটি ৫৬ লাখ, নদীশাসনে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ, বিদ্যুতায়নে ৮৯ কোটি ৯৭ লাখ, প্রশিক্ষণে ১৬ কোটি ৭৯ লাখ, ৫টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে ৩৪ কোটি ৬৯ লাখ, ইন্টারসেকশন উন্নয়ন এবং ১৫টি বাস বে নির্মাণে ৪১ কোটি ৯৮ লাখ এবং সাড়ে ১৩ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণে ২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে।
কম ব্যয়ের কারণ জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব মামুন আল-রশীদ সমকালকে বলেন, প্রকল্পের মূল কাজ কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়েছে। জাইকার পক্ষ থেকে নিবিড় মনিটরিং এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত কিছু অতিপ্রয়োজনীয় নতুন অঙ্গ সংযোজন না হলে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যেত।
পরিবহন খাত বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হক সমকালকে বলেন, প্রকল্পে প্রাক্কলনের জন্য কম টাকা খরচ হওয়া বাংলাদেশে বিরল হলেও অন্যান্য দেশে এ ঘটনা অহরহই ঘটে। কোনো দেশেই এভাবে দফায় প্রকল্প ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ে না। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারকে জরিমানা গুনতে হয়। বাংলাদেশে উল্টো ব্যয় বাড়ানো হয়।
গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এটা একটা বিরল দৃষ্টান্ত। সরকারের উচিত, কোন কোন পদক্ষেপের ফলে সাশ্রয় হলো তা চিহ্নিত করে অন্যান্য প্রকল্পে অনুসরণ করার নির্দেশনা দেওয়া।
উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানো নিয়ে অনেক বার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রাক্কলিত ব্যয় ও সময়ে কাজ শেষ করতে গত মাসেও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ব্যয় বাড়ানোর কিছু সাম্প্রতিক উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- ‘জয়দেপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা’ মহাসড়কের ব্যয় দুই হাজার ৭০০ কোটি থেকে বেড়ে ছয় হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চার হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে কাজ শুরু হওয়া ঢাকা-মাওয়ায় এক্সপ্রেসওয়েতে খরচ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ ব্যয় কাজ শুরুর আগেই ১০ গুণ বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।