ডেস্ক নিউজ
জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে ইতোaমধ্যে যুক্ত হয়েছে দেশের মূল ভূখন্ডে। দ্বীপটিতে যেতে এখন আর পাড়ি দিতে হয় না গভীর সমুদ্র। কক্সবাজার থেকে সংযুক্ত সড়কের মাধ্যমে মাত্র ৩ ঘণ্টার পথ মহেশখালীতে চলছে বিদ্যুত ও জ্বালানি বিভাগের উন্নয়নযজ্ঞ। মাতারবাড়ী বিদ্যুত কেন্দ্রকে ঘিরে ৩১টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে শুধু বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিভাগেরই। এছাড়াও সরকারের অন্যান্য ৫ মন্ত্রণালয় থেকে এখানে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে আরও ৬৮টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পে বিদ্যুত ও জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে খরচ ধরা হয়েছে ৪শ’ কোটি টাকা। সব প্রকল্প মিলিয়ে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে এই মহেশখালীতে। বিশ্বের অন্যতম রোল মডেল হিসেবে দ্বীপটিকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কাজ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সাগরতীরে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে মাতারবাড়ী বিদ্যুত কেন্দ্রে স্থানীয়দের মধ্যে কাজ করছেন প্রায় ২ হাজার শ্রমিক। উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে কাজ করছেন আরও ৫৯০ জন বিদেশী কর্মী। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে উদ্বোধনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন মোট ৭ হাজার কর্মী। এখান থেকেই আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্পের মাধ্যমে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে জানিয়ে বিদ্যুত, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গতি বাড়বে দেশের অর্থনীতিতে। বিদ্যুত প্রকল্পের মহাযজ্ঞের সঙ্গে বদলে গেছে ওই এলাকার জীবনযাত্রা। আগে সেখানে ছিল না কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। পাওয়া যেত না চায়ের দোকানও। বিদ্যুত প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর সেখানেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য খাবার হোটেল। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলটির জীবনযাত্রায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্পের পাশাপাশি এই দ্বীপ অঞ্চলেই নির্মাণ হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। যা মাতারবাড়ির উন্নয়নের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা সময় লবণ ও মাছ চাষ এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস থাকলেও এই প্রকল্পের কারণে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। এখানে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের ভয়াবহ চিত্র দূর হয়ে দেখা দিয়েছে আলোর রেখা। তিনি বলেন, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) আওতায় বাস্তবায়নাধীন এই বিদ্যুতের প্রকল্প ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ইউনিট এবং ওই বছরের জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে বলে আশা করছি। ২০২৬ সালের জুলাইয়ে ওয়ারেন্টি পিরিয়ড সমাপ্তির লক্ষ্য নিয়ে বর্তমানে কাজ চলছে। মাতারবাড়ির এ উন্নয়নে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভূমিকা রাখছে জাপান সরকারও। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) স্বল্প সুদে এ বিদ্যুত প্রকল্পে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি ৩ লাখ টাকা এবং বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা ঋণ দিচ্ছে।
তিনি জানান, দুর্গম অঞ্চলটিতে চলমান দুই মেগা প্রকল্পের মধ্যে ‘মাতারবাড়ি ২৬০০ মেগাওযাট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার’ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এছাড়া ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন’ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। বিদ্যুত এবং জ¦ালানি বিভাগের ৩৮টি প্রকল্পে এখানে খরচ হবে ৪ শ’ কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের আরও অন্তত ৫টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এখানে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে আরও মোট ৬৮টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পে মোট বিনিয়োগ হবে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সম্প্রতি মহেশখালীতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১৬০৫ একর জমির ওপর চলছে ১২০০ মেগাওয়াটের আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুত প্রকল্পের মহাযজ্ঞ। দেশের বাইরে থেকে জাহাজে প্রকল্পের মালামাল নিয়ে আসার জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি স্থায়ী জেটি, যেখানে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রকল্পের কিছু মালামাল নিয়ে একটি জাহাজ ভিড়েছে, যা মাতারবাড়িতে আসা প্রথম জাহাজ। আরও একটি স্থায়ী জেটির কাজ চলমান। যে জেটির কাজে ব্যবহার হচ্ছে ২০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন হ্যামার। এছাড়া, বিদ্যুত উৎপাদনের কয়লা পোড়ানোর জন্য দুটি বয়লারের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
ইতোমধ্যে এক নম্বর বয়লারের পাইলিং শেষ করে বেজমেন্ট ঢালাই দেয়া হয়েছে। দুই নম্বর বয়লারের পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বেজমেন্ট ঢালাইয়ের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া যেন পরিবেশের কম ক্ষতি করে সেজন্য তৈরি করা হচ্ছে ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি। বিদ্যুত উৎপাদন করতে কয়লা পোড়ানোর ফলে যে ছাই তৈরি হবে তা মজুতের জন্য ২৫৫ হেক্টর জমিতে কূপ খনন করা হয়েছে। সেই কূপে পানি রয়েছে। এই পানির নিচেই ২৫ বছর ধরে পোড়ানো কয়লার ছাই মজুত করে রাখা যাবে। সম্পূর্ণ দেশীয় উপায়ে ছাই মজুতের এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া কয়লা গুঁড়া করার কোলমিল, কনভেয়ার বেল্ট (কয়লা পাওয়ার প্লান্টে নিয়ে আসার বেল্ট), ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ওয়াটার প্ল্যান্ট, কেমিক্যাল লুজিং প্ল্যান্টসহ সবগুলো প্ল্যান্টের পাইলিংয়ের কাজ শেষের পথে। জাহাজ থেকে পণ্য খালাস ও প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ৯৬ চাকার চালকবিহীন ট্রাক। বিদ্যুত প্রকল্পের আওতায় ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, আড়াইশ মিটার প্রস্থ এবং ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের সীমানা ঘেঁষে সমুদ্রের পাড়ে চ্যানেলের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি টার্মিনাল থাকবে। এসব টার্মিনালে ১৬ মিটার ড্রাফটের ৮ হাজার টিইইউএস কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়তে পারে না। ফলে মাদার ভেসেলগুলো বন্দরের জেটিতে আসতে পারে না।
তাই ফিডার জাহাজে করে কনটেইনার আনা-নেয়া করতে হয়। প্রতিদিন ৩৫০০ থেকে ৩৮০০ টিইইউএস আমদানি পণ্য কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরে ১৬ মিটার গভীরতার জন্য মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ থাকায় একসঙ্গে আট হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে মাতারবাড়ির এ বন্দর থেকে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।