ডেস্ক নিউজ
হেফাজত নেতারা মনে করছেন, এতে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। নেতৃবৃন্দ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মামুনুলকে নেতৃত্ব থেকে এখনই অপসারণের উদ্যোগ নেয়া না হলেও উত্তেজনা থিতিয়ে এলে পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে বলে সংগঠনের নেতারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করেছেন।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের রিসোর্ট-কাণ্ডে জটিলতায় পড়েছে সংগঠনটি। একের পর এক ফোনালাপ ফাঁস ও কেলেঙ্কারির তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করায় ধর্মভিত্তিক সংগঠনটির ভেতরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও হেফাজতে ইসলামের অনেক নেতা পরস্পরের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তারা সংগঠনের ভাবমূর্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তবে হেফাজত নেতারা প্রকাশ্যে বলছেন, এখনই মামুনুল হককে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। আর হেফাজতে ইসলামের মতো ধর্মীয় সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা কঠিন বিষয়।
মামুনুল হকের ‘দ্বিতীয় বিয়ে’ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে সোমবার হেফাজতের শীর্ষ নেতারা বৈঠক করে তার কাছে বিষয়টি জানতে চান। তবে সংগঠনের শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে এ বিষয়ে এখনই কোনো পদক্ষেপ নিতে চান না সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। বরং তারা প্রকাশ্যে মামুনুলের পক্ষে অবস্থান নেয়ার কৌশল নিয়েছেন।
হেফাজত নেতা মামুনুল হক গত শনিবার এক নারীকে নিয়ে সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন তাকে ঘেরাও করে। মামুনুল ওই নারীকে নিজের ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’ দাবি করলেও এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়।
এ নিয়ে সন্দেহ হলেও কেউ প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। পরে বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন কথোপকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হলে প্রতীয়মান হয়, মামুনুল বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এরই মধ্যে ফেসবুকে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন রিসোর্টে তার সঙ্গীনি জান্নাত আরা ঝর্ণার বড় ছেলে আব্দুর রহমান জামি। তিনি তার মা-বাবার সংসার ভাঙার জন্য মামুনুলকে দায়ী করে বক্তব্য দেন।
জামি বলেন, ‘এখানে আমি আশা করব, আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আশা করব, এর যেন সঠিক বিচার হয়, আপনারা কারও অন্ধ ভক্ত হয়েন না।’
তিনি বলেন, ‘এই লোকটা (মামুনুল) আলেম নামধারী একটা মুখোশধারী একটা জানোয়ার। এর মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব নাই।’
জামির ওই বক্তব্যের পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় হেফাজতে ইসলামে। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সর্বশেষ কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে। এতে এক নেতা অপরজনকে বলেছেন, করোনা পরিস্থিতিতে মামুনুল হকের এমনটা করা উচিত হয়নি।
তবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির ড. আহমেদ আব্দুল কাদের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম দিকের নিউজ দেখে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল যে এটা আসলেই বিয়ে কি না? পরে আমরা মিটিং করেছি। মিটিংয়ে জানা গিয়েছে, তিনি বিয়ে করেছেন। পরে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে বিয়ে হয়েছে ঠিক আছে, যদিও বিয়ের বিষয়ে সামাজিকতার কিছুটা ঘাটতি আছে। ওনার এদিকে না গেলেই ভালো হতো।’
মামুনুলের গোপনে দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি সংগঠনের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি না এটার দরকার আছে।’
বিয়ে কেলেঙ্কারির কারণে সংগঠনে মামুনুলের নেতৃত্ব পুনর্বিবেচনা করা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম একটি ধর্মীয় সংগঠন, কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের লোকেরা এখানে যুক্ত আছে। কাজেই এখানে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া অনেক কঠিন।’
তবে হেফাজত নেতারা প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও রিসোর্ট-কাণ্ড নিয়ে সংগঠনে চাঞ্চল্য চাপা থাকছে না। কয়েকটি অডিওতে মামুনুল হকের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কথা বলতে শোনা গেছে হেফাজতের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে, সেখানে তারা এই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এসব অডিওতে বলা হচ্ছে, মামুনুল হক শুধু হেফাজত নয়, আলেম সমাজের সুনাম নষ্ট করেছেন।
মুখরক্ষার কারণে এখনই মামুনুল হককে বহিষ্কারের পদক্ষেপ না নেয়া হলেও তার পদের ব্যাপারে অদূরভবিষ্যতে পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে সংগঠনটির ভেতরে আলোচনা হচ্ছে। সংগঠনের ‘দুর্বলতা’ প্রকাশ পাবে মনে করে বিষয়টি এসব আলোচনা গোপন রাখার কৌশল নিয়েছেন সংগঠের নেতারা।
হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আব্দুর রব ইউসূফী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় (মামুনুল হকের কথিত দ্বিতীয় বিয়ে) সংগঠনের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘গত শনিবার রিসোর্টের ঘটনায় আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে ওই নারী তার (মামুনুল) ওয়াইফ। আমরা নিশ্চিত হয়েছি বলেই তো বলেছি সে তার স্ত্রী। যেভাবে নিশ্চিত হওয়া দরকার সেভাবেই হইছি।’
এ বিষয়ে সংগঠন কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পদক্ষেপ নেয়া হলে তো জানতেই পারবেন।’
মামুনুলের তথ্যে গরমিল
গত শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রয়্যাল রিসোর্ট নামে একটি আবাসিক অবকাশ যাপন কেন্দ্রে জান্নাত আরা ঝর্ণা নামে এক নারীকে নিয়ে সময় কাটাতে যান হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদের অবরুদ্ধ করে। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
মামুনুল ওই নারীকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দাবি করলেও সাংবাদিকদের প্রশ্ন ও পরে পুলিশের জেরায় তিনি যেসব তথ্য দেন, তাতে অনেক গরমিল পাওয়া যায়।
রিসোর্টের সঙ্গীর নাম, তার বাবার নাম ও বাড়ির ঠিকানা নিয়ে দুই ধরনের তথ্যের পর বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেসবুকে ফাঁস হওয়া বেশ কিছু ফোনালাপ হেফাজত নেতার বিয়ের দাবির সত্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
ফোনালাপের একটিতে বোঝা যায়, ঘটনার পরপরই মামুনুল তার চার সন্তানের জননী স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তিনি বলেন, সেই নারী (ঝর্ণা) তার পরিচিত শহীদুল ইসলামের স্ত্রী। ঘটনার কারণে চাপে পড়ে ওই নারীকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। এ নিয়ে যেন তার স্ত্রী ভুল না বোঝেন। পরে বাসায় এসে বুঝিয়ে বলবেন।
পরে আরেকটি কথোপকথন ফাঁস হয়, যা মামুনুলের সঙ্গে তার রিসোর্টের সঙ্গীনির মধ্যকার বলে প্রতীয়মান হয়। সেখানে ওই নারী জানান, তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তার মায়ের একটি বন্ধ মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। আর অন্য একজন যখন তাকে কোথায় বিয়ে হয়েছে জিজ্ঞেস করেছেন, তখন তিনি বলেছেন, এটা জানেন না। মামুনুলের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।
আরও একটি কথোপকথনে বোঝা যায়, মামুনুলের বোন কথা বলেছেন হেফাজত নেতার চার সন্তানের জননী স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি তাকে বুঝিয়েছেন, কেউ যদি তাকে ফোন করে, তাহলে তিনি যেন বলেন, তিনি এই দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন এবং তার শাশুড়ি এই বিয়ের আয়োজন করেছেন।
এরই মধ্যে মামুনুলের রিসোর্টের সঙ্গীনির বড় ছেলে ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুলের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি তার মায়ের সঙ্গে বাবার সংসার ভাঙার জন্য মামুনুলকে দায়ী করেন।