প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সম্ভব সবকিছু করার আশ্বাস দিয়ে বিজয়ের ইতিহাসকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বেশি করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সঠিক ইতিহাস যাতে সবাই জানতে পারে। কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনকারী বীরের জাতি। সেই বিজয়ের ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন মনে রাখতে পারে, সেই ধরনের চলচ্চিত্র আরও নির্মাণ হওয়া দরকার।’
রোববার সকালে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৯’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে তথ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী সুস্থধারার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে দেখা যায় তেমন সিনেমা যেমন তৈরি করতে হবে, তেমনি শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণটাও একান্ত জরুরি। কারণ এর মাধ্যমেই একজন শিশু তার জীবনটাকে দেখতে পারবে এবং আগামীর জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারবে।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্রে শিল্প ও সংস্কৃতি যেমন থাকবে, তেমনি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য উপকরণও থাকতে হবে। পাশাপাশি সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, নীতি-আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন থাকাটা দরকার।’
চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা যত কথাই বলি না কেন- একটি নাটক, সিনেমা বা গান বা কবিতা দিয়ে অনেক কথা বলা যায় এবং মানুষের অন্তরে প্রবেশ করা যায়। মনের গহিনে প্রবেশ করা যায়। সেজন্য এর একটা আবেদন রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম চলচ্চিত্র। অথচ এটি কিন্তু দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এই ডিজিটাল যুগে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না করা হলে এর আকর্ষণ যেমন থাকে না, তেমনি বাজারও পাওয়া যায় না। সেজন্যই বিএফডিসিকে উন্নত করায় তার সরকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
২০১৯ সালে ২৬টি ক্যাটাগরিতে ৩৩ জন শিল্পী এবং কলাকুশলীকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ পুরস্কার বিজয়ীদের মাঝে পদক, রেপ্লিকা, সম্মাননার চেক এবং সনদ বিতরণ করেন। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা তারিক আনাম খান (আবার বসন্ত) এবং অভিনেত্রী হিসেবে প্রসুনেরাহ বিনতে কামাল (ন ডরাই) পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া শ্রেষ্ঠ খল চরিত্রের জন্য জাহিদ হাসান (সাপলুডু) এবং শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে তানিম রহমান অংশু (ন ডরাই) পুরস্কার লাভ করেন। যৌথভাবে ‘ন ডরাই’ এবং ‘ফাগুন হাওয়ায়’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র মনোনীত হয়। মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা এবং কোহিনুর আক্তার সুচন্দা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। তথ্য সচিব খাজা মিয়া স্বাগত বক্তৃতা করেন। পুরস্কার বিজয়ীদের পক্ষে আজীবন সম্মাননা বিজয়ী মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, চলচ্চিত্রশিল্পে সংশ্লিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ কলাকুশলী এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসসহ গণভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি, কেননা এখন ডিজিটাল যুগ। আমাদের চলচ্চিত্র কেবল দেশে নয়, বিদেশেও যাতে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা সেন্সর সংক্রান্ত আইন ও বিধি আধুনিকভাবে তৈরি এবং সেগুলো কঠোরভাবে যেন মানা হয় সেদিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ১ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড আমরা তৈরি করব। যেখান থেকে অল্প সুদে টাকা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স তৈরি করতে পারবে। যাতে ওই অঞ্চলের মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থাটা হবে।
তিনি বলেন, অনেকগুলো সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই সেগুলোকে পুনরায় চালু করা শুধু নয়, এর আধুনিকায়ন করা দরকার, কারণ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন অনেক উন্নত মানের সিনেমা তৈরি করা যায়। সেদিকেই আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি এবং সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার ভাষণে বলেন, শিল্পের সব মাধ্যমকে একত্রিত করে যে শিল্প সেটাই চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্র শুধু জীবনের কথাই বলে না, এটি সমসাময়িক কালকে সংরক্ষণ করে এবং যেই সময়ে নির্মিত হয় সেই সময়ের সমাজচিত্রকে পরিস্ফুটন করে।
ড. হাছান বলেন, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে যে চলচ্চিত্রশিল্পের যাত্রা শুরু তাকে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শুধু এর স্বর্ণালি দিন ফিরিয়ে আনা নয় বরং আমাদের চলচ্চিত্র যেন বিশ্ববাজারেও একটি স্থান দখল করে নিতে পারে সেই লক্ষ্যে অনেকগুলো পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।
আরও পুরস্কার পেলেন যারা : শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র : নারী জীবন, শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র : যা ছিল অন্ধকারে, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা পার্শ্বচরিত্রে : এম ফজলুর রহমান বাবু (ফাগুন হাওয়ায়), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পার্শ্বচরিত্রে : নারগিস আক্তার (হোসনে আরা) (মায়া দ্য লস্ট মাদার), শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী (যুগ্ম) নাইমুর রহমান আপন (কালো মেঘের ভেলা) ও আফরিন আক্তার (যদি একদিন), শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক : মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ইমন (মায়া দ্য লস্ট মাদার), শ্রেষ্ঠ নৃত্য পরিচালক : হাবিবুর রহমান (মনের মতো মানুষ পাইলাম না), শ্রেষ্ঠ গায়ক : মৃনাল কান্তি দাস (তুমি চাইয়া দেখো) (শাটল ট্রেন), শ্রেষ্ঠ গায়িকা (যুগ্ম) : মমতাজ বেগম (বাড়ির ওই পূর্বধারে) (মায়া দ্য লস্ট মাদার) ও ফাতিমা-তুয-যাহরা ঐশী (মায়া, মায়া রে) (মায়া দ্য লস্ট মাদার)। এছাড়া আরও যারা পুরস্কার পেয়েছেন তারা হলেন- শ্রেষ্ঠ গীতিকার (যুগ্ম) : নির্মলেন্দু গুণ (ইস্টিশনে জন্ম আমার) (কালো মেঘের ভেলা) ও ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী (কবি কামাল চৌধুরী) (চল হে বন্ধু চল) (মায়া দ্য লস্ট মাদার)। শ্রেষ্ঠ সুরকার (যুগ্ম) : প্লাবন কোরেশী (আব্দুল কাদির) (বাড়ির ওই পূর্বধারে) ও সৈয়দ মো. তানভীর তারেক (আমার মায়ের আঁচল) (মায়া দ্য লস্ট মাদার)। শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার : মাসুদ পথিক (মাসুদ রানা) (মায়া দ্য লস্ট মাদার), শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার : মাহবুব উর রহমান (ন ডরাই), শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা : জাকির হোসেন রাজু (মনের মতো মানুষ পাইলাম না) এবং শ্রেষ্ঠ সম্পাদক : জুনায়েদ আহমদ হালিম (মায়া দ্য লস্ট মাদার)।
শ্রেষ্ঠ শিল্প নির্দেশকের (যুগ্ম) পুরস্কার পেয়েছেন মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ বাসু ও মো. ফরিদ আহমেদ (মনের মতো মানুষ পাইলাম না), শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক : সুমন কুমার সরকার (ন ডরাই), শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক : রিপন নাথ (ন ডরাই), শ্রেষ্ঠ পোশাক ও সাজসজ্জা : খোন্দকার সাজিয়া আফরিন (ফাগুন হাওয়ায়) এবং শ্রেষ্ঠ মেকআপ ম্যান : মো. রাজু (মায়া দ্য লস্ট মাদার)।