ডেস্ক নিউজ
গাঙে আসে জোয়ার, আসে ভাটা। সে গাঙে নৌকা নিয়ে জীবনভর ভেসে বেড়ান মানতা সম্প্রদায়ের মানুষ। ভরা জোয়ারে নদীর পানি দু’কূল ছাপিয়ে যায়। কিন্তু সে জোয়ারে এ সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ভরে ওঠে না। বরং সারাজীবন অন্ন বস্ত্র বাসস্থান থেকে শুরু করে সবকিছুতে ভাটার টান লেগেই থাকে। এই প্রথম বারের মতো পিছিয়ে পড়ে থাকা মানতা সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে কিছুটা হলেও উন্নয়নের জোয়ারের ছোঁয়া লাগতে যাচ্ছে। মূলধারার মানুষের মতো তারাও পাচ্ছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। পাচ্ছেন মূলভূমিতে স্থায়ী ঠিকানা। পাচ্ছেন বিদ্যুতের আলো। শিক্ষা চিকিৎসার মতো জীবন ধারণের অন্যান্য উপকরণও পাচ্ছেন হাতের কাছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে বুড়াগৌরাঙ্গ নদের তীরে স্থায়ী হচ্ছেন আধাপাকা বসতঘরে। আর এ কারণে মানতা সম্প্রদায়ের বহরে বয়ে যাচ্ছে খুশির আমেজ। কর্তৃপক্ষ বলছেন এটা প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্যোগ। পর্যায়ক্রমে সম্প্রদায়ের অন্যদেরও একইভাবে সমাজের মূল¯্রােতে নিয়ে আসা হবে। আর এ উদ্যোগকে প্রাণভরে স্বাগত জানিয়ে মানতা সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলছেন, শেখ হাসিনা আমাদের বাঁচার পথ করে দিয়েছেন। এটা আমরা বংশ পরম্পরায় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব।
মানতা সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনধারা অনেকটাই বেদেদের মতো যাযাবর প্রকৃতির। আজ এই নদীতে, কাল অন্য কোন নদী কিংবা সাগর কিনারায়। মাছ ধরে এদের জীবন কাটে। বেদে সম্প্রদায়ের অনেকেরই স্থায়ী ঠিকানা থাকলেও ডাঙ্গায় মানতাদের কোন ঠিকানা নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু। পুরো জীবন কাটে নদীর বুকে ভাসমান নৌকার ছৈয়ের নিচে। বিয়ে শাদিও নৌকায়। অত্যন্ত হতদরিদ্র এই জনগোষ্ঠী সারাদেশেই কমবেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে এদের সংখ্যা অন্য এলাকার তুলনায় বেশি। গলাচিপা লঞ্চঘাট, পানপট্টি লঞ্চঘাট, উলানিয়া বন্দর, কালাইয়া, চরকাজল, চরবিশ^াস, পাটুয়া, পক্ষিয়া, চরমোন্তাজ, মৌডুবি সংলগ্ন নদ-নদী ও সাগরে প্রায়শই এদের বহর বেঁধে নৌকায় বাস করতে দেখা যায়। মাটির বুকে একটি স্থায়ী ঠিকানা এদের আজীবনের চাওয়া। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে বংশ পরম্পরায় এদের কারোরই সে স্বপ্ন পূরণ হয় না। ঝড় বৃষ্টি তুফান সঙ্গী করে নৌকার ছৈয়ের নিচেই কাটে জীবন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে ২৯টি মানতা পরিবারকে ঠাঁই দেয়া হচ্ছে। রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রশাসন সাগরপাড়ের চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বুড়াগৌরাঙ্গ নদ মোহনার পাড়ে এ উদ্যোগ নিয়েছে।
ইতোমধ্যে প্রত্যেকটি পরিবারের জন্য পৃথক রঙিন টিনশেডের সেমিপাকা ঘরের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে পাকা ল্যাট্রিন। বসানো হয়েছে গভীর নলকূপ। প্রত্যেকটি ঘরের সঙ্গে থাকছে চার শতক জমির দলিল। যাদের ঘর দেয়া হচ্ছে, তাদের তালিকাও প্রস্তুত হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যাদের ঘর দেয়া হচ্ছে তাদের মাসিক আয় দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা। অথচ প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে গড়ে পাঁচ সদস্য। এতেই বোঝা যাচ্ছে সম্প্রদায়ের এসব মানুষ কতটা হতদরিদ্র অবস্থায় দিন কাটান। এদের কারোরই ডাঙ্গায় জমি কিনে ঘর তোলার সামর্থ্য নেই।
এখন থেকে নদীর পানি আর ঝড়-ঝঞ্ঝার সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে ওঠা মানতা সম্প্রদায়ের এসব মানুষের স্থান হবে ডাঙ্গায়। মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে পাওয়া সেমিপাকা স্থায়ী ঘরে। ঠিকানা পাবেন মাটিতে। পাবেন শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল মৌলিক অধিকার। স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা তারা।
ঘর পাওয়ার খুশিতে কথা বলেছেন মানতা সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। ষাটোর্ধ মারফত সরদার বলেন, জন্ম থিহা গাঙের নায় থাহি। মোর যে এককান ঘর হইবে, কহনো ভাবি নাই। শেখ হাসিনা মোগো ঘর দেতেছেন। এহার চাইতে আর বড় কিছু চাওয়ার নাই। দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে নৌকার সংসার চল্লিশোর্ধ গয়জদ্দিন সরদারের। বলেন, নৌকার জীবন যে কত কষ্টের, তা আপনাদের বোঝাতে পারব না। ঝড় বন্যায় প্রায়ই আমাদের সব ভেসে যায়। তারপরও আমাদের নৌকায় বাস করতে হয়। আলেয়া জান বিবি (৪০) বলেন, এ পর্যন্ত কত সরকার এসেছে। কিন্তু আমাদের জন্য কেউ কিছু করেনি। স্বামী, ছেলে মেয়ে নিয়ে আমরা নৌকায় জীবন কাটাই। এখন শেখ হাসিনা আমাদের ঘর দিয়েছেন। এ ঘরের চালের নিচে এখন থেকে আমাদের জীবন কাটবে। ঝড় বন্যার ভয় থাকবে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন লেখাপড়াও শিখতে পারবে। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ যেন তারে ভাল রাখে। মিনারা জান বিবি (৩২) বলেন, আমরা লেখাপড়া শিখতে পারিনি। নাম লিখতেও পারি না। আমাদের ছেলেমেয়েরা বিদ্যুতের আলোয় ঘরে বসে লেখাপড়া করবে, চিকিৎসা পাবে, এত স্বপ্ন কোনদিনই দেখিনি। খোদা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করেছে, এরবেশি কিছু চাই না। শেখ হাসিনা যেন আরও বহু বছর বেঁচে থাকেন, সেটাই চাই। চান মিয়া সরদার (৪০) ও লিপিজান বিবি (৩৫) বলেন, আমাদের জায়গা নাই। জমি নাই। এখন দুটোই হয়েছে। আমাদের আর কোন দুঃখ নেই। আক্তার সরদার, নাজমা বিবি,আমজাদ সরদারসহ আরও কয়েকজন একই ধরনের অনুভূতি জানিয়ে বলেছেন, নদীর পাড়ে আবাসন হওয়ায় তাদের আরেকটি সুবিধা হয়েছে। নৌকা ঘাটে রেখে তারা ঘরেই রাত কাটাতে পারবেন। আবার কাছাকাছি বাজারের সুবিধাও পাবেন। একই সঙ্গে পাবেন অন্যান্য নাগরিক সুবিধা।
ঘর ও অন্যান্য প্রসঙ্গে রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ হানিফ মিয়া বলেন, আগে মানতাদের ভোটাধিকার ছিল না। তাদের সকলকে এরইমধ্যে ভোটার করা হয়েছে। তাদের ত্রাণ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। ঘরের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। শীঘ্রই প্রত্যেকের কাছে ঘরের চাবি আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে দেয়া হবে।
ঘর নির্মাণ থেকে তালিকা প্রণয়ন এবং সার্বক্ষণিক যাবতীয় কাজ সরেজমিন তদারক করে মানতা সম্প্র্রদায়ের কাছে এরইমধ্যে প্রিয় মানুষে পরিণত হয়েছেন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাশফাকুর রহমান। তিনি বলেন, মানতা সম্প্রদায়ের মানুষ যে কতটা অসহায়, অবহেলিত, বঞ্চিত এবং প্রকৃতি নির্ভর, তা গভীর ভাবে না মিশলে বোঝা যাবে না। তাই এ সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য যতটা করা সম্ভব, তাই করা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ২৯টি পরিবারকে ঘরের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার নদ-নদীতে ভাসমান অন্যদেরও সমাজের মূল¯্রােতে নিয়ে আসা হবে।