মুজিব জন্মশতবর্ষে ৯ লাখ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার পাচ্ছে সেমিপাকা টিনশেড ঘর। সারা দেশে ৬৪টি জেলার তৃণমূল পর্যায়ে তালিকা করে ছিন্নমূল ও দুস্থ পরিবারকে এ ধরনের বিশেষ ঘর দেওয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপে ২৩ জানুয়ারি ৬৯ হাজার ৯০৪ পরিবারকে হস্তান্তর করা হবে। প্রতিটি পরিবারের জন্য সর্বনিম্ন ২ শতাংশ খাসজমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও দেওয়া হয়েছে তিন বা পাঁচ শতাংশ জমি। এর মধ্যে দুটি শোয়ার ঘর, একটি বসার ঘর, একটি টয়লেট এবং একটি রান্নার ঘর রয়েছে। ঘরপ্রতি ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ হিসেবে গৃহহীনদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ১১৬৮ দশমিক ৭১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। আগামী ২৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। জানা যায়, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালের জুন মাসে। ডিপিপি অনুযায়ী বরাদ্দ হওয়ার অর্থের পরিমাণ ৪৮২৬ দশমিক ১৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই আরও ১ লাখ একক গৃহ বরাদ্দ করা হবে। পর্যায়ক্রমে প্রায় ৯ লাখ ভূমিহীন পরিবারকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহবুব হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে মোট ৯ লাখ পরিবারকে ঘর দেওয়া হবে। এর প্রথম ধাপে আগামী ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে ৭৪৩টি ব্যারাকে ৩ হাজার ৭১৫ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। তিনি বলেন, ‘এক মাসের মধ্যে আরও বরাদ্দ করা হবে ১ লাখ ঘর। এ জন্য আমরা দুটি তালিকা তৈরি করেছি। একটি তালিকা করা হয়েছে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের। অর্থাৎ যাদের ঘর ও জমি নেই। এর সংখ্যা ২ লাখ ৯৩ হাজার ৬১টি পরিবার। আর দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছেন, যাদের জমি আছে কিন্তু ঘর নেই। এ তালিকা ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১।’
জানা যায়, অধিকাংশ গৃহ নির্মাণের কাজ শেষের পথে। মুজিববর্ষে ২১ জেলার ৩৬ উপজেলায় ৪৪টি প্রকল্প গ্রামে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণের মাধ্যমে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। একই সঙ্গে একক গৃহ ও ব্যারাকে মোট ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর দেওয়ার ঘটনা বিশ্বে এটাই প্রথম। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ২৪ হাজার ৫৩৮টি পরিবারের জন্য মোট বরাদ্দ ৪১৯ দশমিক ৬০ কোটি টাকা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৩৮ হাজার ৫৮৬টি ঘর বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫৯ দশমিক ৮২ কোটি টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গুচ্ছগ্রাম দ্বিতীয় পর্যায়ে সিভিআরপি প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ৬৫টি ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ ৫২ দশমিক ৪১ কোটি টাকা। অতিরিক্ত পরিবহন বাবদ বরাদ্দ (প্রতিটি ঘরের জন্য ৪ হাজার টাকা) মোট ২৬ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া সারা দেশের সব উপজেলায় জ্বালানি বাবদ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৪০ কোটি টাকা। মোট ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবারের ঘরের জন্য বরাদ্দ ১১৬৮ দশমিক ৭১ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প একক গৃহ নির্মাণের সামগ্রিক কার্যক্রম সমন্বয় করছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে একক গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে আমাদের অঙ্গীকার, দেশে একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। মুজিববর্ষে ৯ লাখ ভূমিহীন মানুষকে ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন বলেই সম্ভব হয়েছে। কারণ জাতির পিতা দেশের গরিব, অসহায় ও দুঃখী মানুষের কথা ভাবতেন। তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। জাতির পিতার পথ অনুসরণ করে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসহায় মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন।’
সরকারের হিসাবমতে, সারা দেশে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১ লাখ ২৯ হাজার ১৯৭, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬ হাজার ৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৯৭, রংপুর বিভাগে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩৪, রাজশাহী বিভাগে ৯৬ হাজার ৫০৪, খুলনা বিভাগে ১ লাখ ৪২ হাজার ৪১১, বরিশাল বিভাগে ৮০ হাজার ৫৮৪ এবং সিলেট বিভাগে ৫৫ হাজার ৬২২টি গৃহহীন পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে জমি ও ঘর নেই এমন পরিবারের পাশাপাশি ১০ শতাংশ জমি আছে কিন্তু জরাজীর্ণ বাড়ি এমনও পরিবার রয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আশ্রয়ণ প্রকল্পের সংখ্যা ২ হাজার ১৭২টি। নির্মিত ব্যারাক সংখ্যা ২২ হাজার ১৬৪টি। ব্যারাকে পুনর্বাসিত ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৬৮টি। জমি আছে কিন্তু ঘর তৈরির সামর্থ্য নেই এমন ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৪ পরিবারকে সহযোগিতা করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের জন্য নির্মিত বিশেষ ডিজাইনের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ৫৮০টি। ২৩ বছরে পুনর্বাসিত পরিবারের সংখ্যা ৩ লাখ ২০ হাজার ৫২টি। এর আগে মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসেবে কক্সবাজার জেলার খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত পাঁচতলাবিশিষ্ট ২০টি বহুতল ভবনে প্রথম পর্যায়ে ৬০০টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে একটি করে ফ্ল্যাট উপহার দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় পাঁচতলাবিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার পুনর্বাসন করা হবে। খুরুশকুল প্রকল্পটি বিশ্বের একক বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী ২৩ জুলাই এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। বাকি ১১৯টি বহুতল ভবন ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ কর্তৃক পৃথক ডিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গৃহহীনরা গৃহ পাবে, ঘরহীনরা ঘর পাবে এমন নজির বিশ্বে বিরল। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী গৃহহীনদের ঘর করে ও আশ্রয়হীনদের আশ্রয় করে দিচ্ছেন।’ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তার উপজেলায় ১৪৩টি গৃহহীন পরিবারকে নতুন সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী এসব ঘর উদ্বোধন করবেন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেজবাউল করিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় তাড়াশ উপজেলায় ১৫২টি পরিবারকে প্রথম ধাপে ঘর তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। স্বামীপরিত্যক্তা, বিধবা, ভূমিহীন ও গৃহহীনদের যাচাই-বাছাই করে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।’ রায়গঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুবীর কুমার দাশ বলেন, রায়গঞ্জ উপজেলায় ১০০ গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে। ৫৭৬ জন আবেদনকারীর মধ্যে তিন দফা যাচাই-বাছাই করে ৫টি ইউনিয়নের প্রকৃত গৃহহীনদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।