ডেস্ক নিউজ
মানিকগঞ্জের শিবালয়ের তেওতা গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর অধীনে ভূমিহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ শেষ। আগামী ২০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। ৬৫ বছর বয়সী মজিরন বেগম একটা ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। কথা বলার সময় তিনি দু’হাত তুললেন আসমানের দিকে। বয়সের ভারে মলিন মুখে দ্যুতিময় হাসি। চোখে আনন্দাশ্রু। বললেন, ‘আমাগো শেখ হাসিনা মাথা গোঁজার ঠাঁই দিছে। যতদিন বাঁইচে আছি, দিন-রাত তার জন্য দোয়া করমু।’ খুলনার ডুমুরিয়ায় ভূমিহীনদের জন্য সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে ঘর বরাদ্দ পাওয়া ছিন্নমূলদের একজন ফুলি বেগম। গত জানুয়ারি মাসে ঘর পাওয়ার পর থেকে তার জীবনের গল্প অনেকটাই বদলে গেছে। ‘আগে পরের জায়গায় ফুটপাতে পড়ি থাকি লাথি-উষ্ঠা খাইয়া থাকিতাম। এখন এই ঘর পাইছি। পাকা ঘর, টিনের চাল। অনেক ভালো আছি। শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি, আল্লা ওনার ভালো করুন, অনেক দিন ভালোভাবে বাঁচিয়া রাখুন।’ বলছিলেন ৪৫ বছর বয়সী ফুলি বেগম।
শুধু ফুলি বেগম কিংবা মজিরন নন- মানিকগঞ্জের শিবালয়, খুলনার ডুমুরিয়া, গোপালগঞ্জের হরিদাসপুরের মালেঙ্গা গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্প সরেজমিনে ঘোরার সময় তাদের কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে তৃষ্ণা, মালেক, শংকর, কুলসুমদের কণ্ঠেও। তাদের জীবন বদলে যাওয়ার গল্পটা শুরু হয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার মধ্য দিয়ে। এখন তাদের সংগ্রাম জীবিকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৯৭ সালেই নিয়েছিলেন আশ্রয়ণ প্রকল্প। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আবারও গ্রহণ করা হয় আশ্রয়ণ প্রকল্প।
দিনবদল ও জীবিকার সংগ্রাম: দশ বছর আগে ফুলি বেগমের স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। কিশোর বয়সী এক মেয়ে, আর কোলে আরেক শিশু নিয়ে খুলনার চুকনগরের ফুলি বেগমের জীবন-সংগ্রাম শুরু হয়। নিজের জায়গা-জমি নেই। থাকতে হয় ফুটপাতে পলিথিনের ছাউনির নিচে। ফুটপাতে খড় বিছিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে ঘুমাতেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের মুখে যৎসামান্য খাবার তুলে দিতেন। এভাবেই কেটে যায় দশ বছর। কিশোরী মেয়েটির বয়স বিশ বছর পূর্ণ হলে বিয়ে দেন। ছোটটি এখন কিশোরী। এরই মধ্যে এক দিন এলাকার কয়েকজনকে আলাপ করতে দেখলেন, শেখ হাসিনার সরকার ভূমিহীনদের জমি আর ঘর দিচ্ছে। এলাকার চেয়ারম্যান আর সরকারি কর্মকর্তারা ভূমিহীনদের তালিকা করছেন। ফুলি বেগম তাদের কাছে গেলেন, নিজের দুঃখের কথা জানালেন। পরে তাকে জানানো হয় তিনি ডুমুরিয়ায় একটা ঘর পাবেন। গত জানুয়ারিতে সেই ঘর পেয়ে যান তিনি।
কথায় কথায় ফুলি বেগম জানালেন, ঘর পাওয়ার পর রাতে ঘুমানোর কষ্ট আর নাই। এখন বৃষ্টি এলে ভিজতে হয় না, গরমের তাপে পুড়তে হয় না। রাতের পর রাত দুশ্চিন্তায় ঘুম আসত না। বিশেষ করে আকাশে মেঘ করলেই বুক কেঁপে উঠত। ঝড় উঠলে আশপাশে কারও ঘরের বারান্দায়, কোনো দোকানের চালার নিচে ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে বসতে হতো। এখন সেই দুশ্চিন্তার দিন গেছে। রাতে পাকা ঘরের মেঝেতে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়লে দিব্যি ঘুমে আসে।
কিন্তু ফুলি বেগমের জীবিকার সংগ্রাম এখনও আগের মতোই।
আগে এর-ওর বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে আসার পরে আশপাশে কাজ জুটল না। ফুলি বেগম নতুন এক উপায় খুঁজলেন। আড়াই হাজার টাকা ধার নিলেন পরিচিত একজনের কাছ থেকে। সেই টাকায় মেয়েদের কানের দুল, হাতের চুরি, চুলের ফিতা, পুঁতির মালা কিনেছেন। এগুলো নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। যে টাকা হয়, সেটা দিয়ে একটু একটু করে ধার শোধ করছেন, ছোট মেয়েটাকে নিয়ে কোনো রকমে খেয়ে পড়ে আছেন।
তৃষ্ণা নন্দীর গল্পটা একটু অন্যরকম। তিনিও চুকনগর থেকে এসেছেন। স্বামী পরিমল নন্দী শ্রমিকের কাজ করেন। কখনও স’মিলে, কখনও ইটের ভাটায়, কখনও মাটি কাটার কাজ। তৃষ্ণা নিজেও আগে মাটি কাটার কাজ করতেন। এখন ঘরেই থাকছেন। কারণ কাজ কমে গেছে। স্বামীকেই এক-দুই দিন পর পর কাজ খুঁজতে হয়। মহামারির সময়ে তৃষ্ণার কাজ জোটানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। ‘কাজ করতি চাই, করোনার মধ্যি কাজই তো পাই না। তার দুঃখ, সরকার ঘর দিল, একটা চৌকি যদি দিত।’ ঘরে ওঠার পর মেঝেতেই বিছানা করে থাকতে হচ্ছে। দিনে এনে দিনে খাওয়ার জীবনে একটা চৌকি এখনও কেনার সামর্থ্য তাদের গত তিন মাসেও হয়নি!
ডুমুরিয়ার এই প্রকল্পে দেখা গেল হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি ঘরে আছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ, সেই শাশ্বত সত্যটি এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের মধ্যেও দেখা গেল। ডুমুরিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ সমকালকে জানালেন, এ এলাকায় আবহমানকাল ধরেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অত্যন্ত মজবুত, এটা এখানকার ঐতিহ্য। আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরাদ্দের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয় নয়, ভূমিহীন এবং গৃহহীন কিনা সেটাই দেখা হয়েছে। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে ৬৪টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এখন আরও ৪৫টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে।
গোপালগঞ্জের হরিদাসপুরে বেড়াখাল নদীর তীরে মালেঙ্গা গ্রামে গড়ে উঠেছে ৩০০ ঘরের আবাসন প্রকল্প। এটিকে আরও সম্প্রসারিত করার কাজও চোখে পড়ল। এখানে সরেজমিনে ঘুরে অধিকাংশ ঘরে তালা ঝুলতে দেখা গেল। কারণটা জানালেন বরাদ্দ পাওয়া একজন রোজি। তিনি জানালেন, দশ-পনেরো দিন আগে এই ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। স্বামী জালাল শেখের সঙ্গে এসেছিলেন চার সন্তানসহ। কিন্তু বিদ্যুৎ নেই। যে কারণে ফ্যান লাগাতে পারেননি। প্রচণ্ড গরমে ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়। এরপর জালাল শেখ একাই থাকতেন। ক’দিন হলো তিনি আবার বাচ্চাদের নিয়ে ঘরে উঠেছেন। বিদ্যুৎ না থাকার কারণেই অনেকে বরাদ্দ পেলেও ঘরে থাকছেন না বলে জানান রোজি।
প্রকল্প-সংশ্নিষ্টরা জানালেন, বিদ্যুৎ সংযোগের প্রক্রিয়াও চলছে। খুব তাড়াতাড়িই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে।
যেভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্প: আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর মাধ্যমে দুইভাবে গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। যাদের নিজের এক টুকরো জমি আছে, কিন্তু ঘর নির্মাণের সামর্থ্য নেই তাদের জন্য সরকার ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে। আর যারা ভূমিহীন, ছিন্নমূল তাদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর ও ঘরের জমি দুটোই দেওয়া হচ্ছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ৩০টি গ্রামে ১৯ হাজার ৮৭৮টি ব্যারাক নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যারাকে পুনর্বাসিত ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৫৪ হাজার ২৩৮টি। যার জমি আছে, ঘর নেই এমন গৃহহীনদের জন্য নির্মিত ঘরের সংখ্যা ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৭টি। এ সময়ে পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারের জন্য বিশেষ নকশার ঘর নির্মাণ করা হয়েছে ২১৪টি।
২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নির্মিতব্য প্রকল্পে গ্রামের সংখ্যা ৪১৮। ব্যারাকের সংখ্যা ৬ হাজার ৪৪৫টি। পুনর্বাসিত ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা হবে ৩২ হাজার ২২৫টি। আর জমি আছে, ঘর নেই এমন গৃহহীনদের জন্য নির্মিতব্য ঘরের সংখ্যা ২৭ হাজার ২৯টি। পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ নকশার ঘরের সংখ্যা ৩৩৬টি।
আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ‘দেশে কেউই গৃহহীন থাকবে না’। এই লক্ষ্য নিয়েই মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জমি ও ঘর দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণে প্রথম পর্যায়ে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং চলতি বছরে প্রতিটি ঘর নির্মাণে ২ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই পর্যায়ে প্রকল্প ব্যয় প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই আসছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।