- তিন অংশে ভাগ করা হয়েছে পুরো প্রকল্প
- আগামী বছরের ডিসেম্বরে প্রথম অংশের উদ্বোধন
- পুরো কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে
- বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা
রাজন ভট্টাচার্য ॥ নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়ে চলছে যানজট নিরসনে সবচেয়ে আশার প্রকল্প ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। রাজধানী শহরের উত্তর-দক্ষিণ অংশের সংযোগ ও ট্রাফিক ধারণক্ষমতা বাড়াতেই এ প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয়। তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে পুরো প্রকল্প। তবে একসঙ্গে পুরো কাজ শেষ হচ্ছে না। ভাগে ভাগে খুলে দেয়া হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এর প্রথম অংশ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খুলে দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সবটুকু শেষ হবে ২০২৩ সালের জুন মাসে।
চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ১৯ ভাগ। প্রথম ধাপের অগ্রগতি ৫৬ ভাগ বলে জানা গেছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ আধাঘণ্টা। তবে টোল দিয়ে ব্যবহার করতে হবে দেশের প্রথম এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করা হয়েছিল। এরপর প্রকল্পের একাধিক অংশের নক্সা পরিবর্তন, আর্থিক সঙ্কট, জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতাসহ নানা কারণে কাজের গতি খুবই মন্থর। এ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার নানা সঙ্কটের কথা তুলে ধরে তা সমাধানে কাজ চলছে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সঙ্কটের সমাধান হলেও নির্মাণে গতি কম। সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো নির্মাণ গতি প্রকল্পের প্রথমাংশেই। অর্থাৎ বিমানবন্দর থেকে বনানী অংশে। দ্বিতীয় অংশে মাত্র ১০টি পাইল স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। আর তৃতীয় অংশে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন বিমানবন্দর থেকে ঢাকা হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী যেতে সময় লাগে কমপক্ষে তিন থেকে চার ঘণ্টা। ছুটির দিনে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। গাড়ির চাপ বেশি থাকলে সময় আরও বাড়ে। ১৯৮৩ সালে গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইনের দুপাশে সড়কপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হলেও এক পর্যায়ে তা বাতিল করা হয়। ফলে দীর্ঘ সময়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিকল্প কিছু নির্মাণ সম্ভব হয়নি। যার প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন যানজটের দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে তিন জেলার বাসিন্দাদের চলতে হচ্ছে।
তারা বলছেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এই প্রকল্পের কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে। কিন্তু আশানরূপ অগ্রগতি নেই। তবুও যানজটের ভোগান্তি এড়াতে আশাকরি সামনের দিনগুলোতে নির্মাণে গতি বাড়বে।
এখন প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের কাজ চলছে বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত। তৃতীয় ভাগে কাজ হবে তেজগাঁও থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত। যানজটের ধকল থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে মেট্রোরেল, বাস র্যা পিড ট্রানজিট (বিআরটি), ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এরই পর্যায়ে নির্মীয়মাণ প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রথম অংশটি সাত দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয় অংশ পাঁচ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার ও তৃতীয় অংশ ছয় কিলোমিটারের কিছু বেশি। সব মিলিয়ে মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ওড়াল সড়কে ওঠানামার জন্য র্যা ম থাকবে ৩১টি। র্যা মসহ প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অর্থায়ন করছে ইতাল থাই এবং চাইনিজ কোম্পানি সিনোহাইড্রো ও চায়না সেনডং। এর মধ্যে ইতাল থাইয়ের মালিকানা ৫১ শতাংশ। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে সিনোহাইড্রো ১৪ শতাংশ এবং চায়না সেনডংয়ের মালিকানা ৩৫ শতাংশ। ইতোমধ্যে তিন কোম্পানি মিলে চায়না এক্সিম ব্যাংক ও আইসিবিসি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৮৬১ মিলিয়ন ডলার। টাকার অঙ্কে ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ব্যাংক দুটি প্রথম কিস্তি ৫৫ মিলিয়র ডলার ইতোমধ্যে ছাড় করেছে। চলতি মাসের শেষ দিকে দ্বিতীয় কিস্তি ১০০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করার কথা রয়েছে।
প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার বলেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের প্রায় ১১ কিলোমিটার অংশের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এর পরপরই এই অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার চিন্তা করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা ও নামার ৩১টি র্যা ম থাকবে। ওঠা যাবে ১৫টি পয়েন্টে আর নামা যাবে ১৬টি পয়েন্টে। মূল এক্সপ্রেসওয়েটি হবে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এর বাইরে র্যা ম হবে ২৭ কিলোমিটার।
তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের ওপর মোট ৮টি পয়েন্টে থাকবে ৮টি টোল প্লাজা। নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ হলে নগরীর বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা থেকে একেবারে কুতুবখালী পর্যন্ত খুব স্বল্প সময়ে পৌঁছা যাবে। সময় এবং খরচ দুটোই সাশ্রয় হবে। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলবে ৮০ কিলোমিটার বেগে। কোন রকম থ্রি-হুইলার উঠতে পারবে না। যানবাহনের জন্য খুলে দেয়া হলে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট, মগবাজার, পল্টন, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত সড়কের ওপর গাড়ির চাপ অনেকাংশে কমে যাবে। জনভোগান্তিও কমবে বলে জানান তিনি।
চলতি বছরের আগস্টের মাঝামাঝি প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথমভাগে কাওলা থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত ৫৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই অংশটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে খুলে দেয়ার চিন্তা ছিল প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। কিন্তু স্বল্প দূরত্ব হওয়ায় এই চিন্তা থেকে সরে এসেছে কর্তৃপক্ষ। তবে প্রকল্প পরিচালক জানান প্রথম অংশের কাজ শেষ হয়েছে ৫৬ ভাগ।
কাওলা থেকে বনানী রেলগেট পর্যন্ত অংশে প্রথম ধাপের ১ হাজার ৩৩৩টি ওয়ার্কিং পাইল ড্রাইভিং, ৩২৩টি পাইল কেব, ১২৫টি ক্রস ভিম, ২৩৬টি কলাম (সম্পূর্ণ) ও ১৭১টি কলাম (আংশিক), ১৯৮টি আই গার্ডার কাস্টিং এবং ১৫৭টি আই গার্ডার স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত মার্চ থেকে প্রায় তিন মাস কাজ বন্ধ থাকায় কাজের গতি কিছুটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন পুরোদমে কাজ শুরু হওয়ায় গার্ডার তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে প্রথম ভাগের কাজ অনেকটা দৃশ্যমান হবে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কাজে যাতে বিঘœ না ঘটে সে জন্য প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রকৌশলী, শ্রমিক সবার থাকার ব্যবস্থা প্রকল্প এলাকাতেই করা হয়েছে। করোনা সংক্রমণ আবার ছড়িয়ে পড়লে কেউ প্রকল্প এলাকা থেকে বাইরে যেন না যান সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
এদিকে চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রকল্পের বুয়েট-হাতিরঝিল লিংকের এলাইনমেন্ট চূড়ান্ত করা হয়। সে প্রেক্ষিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ডিটেইল্ড ডিজাইন সংশোধনের কাজ চলছে বলেও জানা গেছে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ২০ জন আই গার্ডার নির্মাণ বিশেষজ্ঞ গত জুলাই মাসে বাংলাদেশে এসেছেন। গত মাসে আরও ১০ জন বিশেষজ্ঞ এসেছেন বলেও জানা গেছে।
চলতি মাসের শুরুতে সেতু বিভাগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সেতু বিভাগের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি ও এয়ারপোর্ট থেকে আশুলিয়া বাইপাইল হয়ে ঢাকা ইডিজেড পর্যন্ত চার লেনের সড়ক এবং উড়ালপথ নির্মাণ প্রকল্পে ধীরগতি স্পষ্ট। এলিভেটেড প্রকল্পের কাজে আশানরূপ অগ্রগতি নেই। তিনি বলেন, আপনারা আমাকে বারবার বলে আসছেন সমস্যা নেই, আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়েছে। তকে কেন প্রত্যাশিত গতিতে কাজ এগুচ্ছে না। প্রায় দুই বছর শেষ হয়ে গেছে এখন ভৌত কাজেই শুরু করা যায়নি। হয়নি লোন এগ্রিমেন্ট। শুনেছি ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে হবে।
২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট এই প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করা হয়েছিল। তখন কথা ছিল ২০১৮ সালেই ঢাকায় উড়াল সড়কে চলবে গাড়ি। পরে এই প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের মধ্যে শেষ করার কথা বলা হয়েছিল। এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির কথা জানানো হয়। এখন বলা হচ্ছে ২০২৩ সালে শেষ হবে পুরো প্রকল্পের কাজ।
পিপিপির ভিত্তিতে এর নির্মাণকাজ পাওয়ার পর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিও গঠন করে ইতালথাই। এ কোম্পানির মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ২৫ বছর পরিচালনা (সাড়ে তিন বছর নির্মাণকালসহ) এবং টোল আদায় করা হবে। টোল আদায়ের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা টাকা তুলে নেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত আর্থিক জোগান না হওয়া ও জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সময়মতো কাজ শুরু সম্ভব হয়নি। মূলত এ কারণেই প্রকল্পটি পিছিয়েছে। আর্থিক সমস্যা সমাধান হওয়ায় ইতোমধ্যে কাজের গতি বেড়েছে, চীন থেকে আসা লোকজন কাজে যোগ দিয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের কাজও চলমান।
তারা জানান, আই গার্ডর রোড নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০টি সম্পন্ন হয়েছে। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে প্রকল্পের প্রথমাংশের কাজ আরও বেশি দৃশ্যমান হবে।
পুরো কাজ ৪২ মাসের জানিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, ২০২৩ সালের জুন মাসে আমাদের প্রত্যাশা কাজ শেষ হবে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও রেলগেট এলাকা পর্যন্ত প্রথম অংশের পুরোটা ও দ্বিতীয় অংশের বেশিরভাগ জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হবে। এজন্য কুড়িল এলাকায় কন্ট্রোল রুম স্থাপনের কাজ চলছে। সেখান থেকে পুরো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মনিটরিং করা হবে। প্রকল্পের শেষ অংশের জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে কর্মকর্তারা বলেন, এই অংশে খুব বেশি জটিলতা হবে না। কারণ বেশিরভাগ রেলের জমি ব্যবহার করা হবে। দ্বিতীয় অংশের কাজ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে জানিয়ে কর্মকর্তারা বলেন, এই অংশে ইতোমধ্যে ১০টি পাইল স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।