ডেস্ক নিউজ
ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ হত্যার জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত এবং পলাতক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং অন্যান্যদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মোটা অংকের পুরস্কার ঘোষণার খবরটি নিশ্চিতভাবে অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু মেজর জিয়ার মতো ধর্মান্ধ জঙ্গিদের দমন কাজে বাংলাদেশে যে বাহিনীটি বহুলাংশে সাফল্য অর্জন করেছে, সেই র্যাবের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ ঠিক উল্টো কাজটিই করে বাংলাদেশের সকল শান্তিপ্রিয় মানুষের নিন্দার শিকার হয়েছেন।
গত কয়েক বছর র্যাব বাংলাদেশে জঙ্গি দমন, মাদক দমন, জলদস্যু দমন, দুর্নীতিবাজদের পাকড়াওসহ অন্যান্য হিতকর কাজের দ্বারা সমাজ জীবনে শান্তি ফেরাতে নিরলস কাজ করেছে বলে সাধারণ মানুষের কাছে এর প্রচুর জনপ্রিয়তা রয়েছে। বাংলাদেশে উগ্র জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থা দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী র্যাব সাধারণ মানুষের কাছে প্রশংসা অর্জন করেছে। শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই প্রমুখ তালেবানি জঙ্গিদের দমন দিয়ে র্যাব জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ দমনে শুরু থেকেই ভূমিকা রেখে আসছিল।
২০১৩ সালের ৫ মে তারিখে হেফাজতি জঙ্গিদের উৎখাত, হলি আর্টিসান আক্রমণকারীদের চিহ্নিত এবং ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য র্যাবের একের পর এক সাঁড়াশি অভিযান সকলেরই প্রশংসা কুড়িয়েছে। সুন্দরবনে এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলে জলদস্যুদের দমনও র্যাবের সফলতা।
বিগত কয়েক বছরে র্যাব বেশ কয়েকজন সুচতুর ধর্ষক এবং করোনাকালে কয়েকটি প্রতারক হাসপাতাল মালিকদের পাকড়াও করে। এতোকিছু সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের এই বাহিনীর সব সাফল্য এড়িয়ে গিয়ে র্যাবের বিরুদ্ধাচরণ করায়, গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী লোক ছাড়া বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক বিস্মিত। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে এবং সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী কয়েকজন ধর্মান্ধকে আটক করে র্যাব অর্জন করেছে প্রচুর জনপ্রিয়তা। যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী জঙ্গি দমনের কথা বলছে অত্যন্ত উচ্চস্বরে, সেই দেশটিই কী করে বাংলাদেশে জঙ্গি দমনের কাজে সফল সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করলো?
বিভিন্নজন মার্কিন সিদ্ধান্তকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে দলীয় বা আদর্শগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত কিছু ব্যক্তি ছাড়া প্রায় সকলেই মার্কিন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে এশিয়া-প্রশান্ত কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের সমর্থন আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগের পন্থা হিসেবেই এটি করেছে। পৃথিবীর কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ে রাখার প্রচেষ্টা বহুকাল ধরেই করে আসছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁর পতনের আগ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের পক্ষেই অবস্থান নিতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাপ্তির পরে বর্তমান রাশিয়ার বিশ্ব মোড়লগিরি করার প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোটেও কম নয়। পৃথিবীতে মোড়লের ভূমিকা বজায় রাখার জন্য এরা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। উপনিবেশবাদের পতনের পর শুরু হয়েছে নব্য উপনিবেশবাদ, যার মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক ফায়দা লুটা। সে লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী দেশ কারো থেকে কেউ কম যায় না। এক সময়ের তুলনামূলক স্বল্পোন্নত দেশ চীন আজ আর্থিক এবং সামরিক দিক থেকে মহীরূহ হিসেবে পরিণত হওয়ার পর সেও বিশ্ব মোড়লের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ঠিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই, সে দেশটির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। বলা যেতে পারে চীনের এহেন প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও একধাপ উপরে। তবে বিশ্ব মোড়লগিরিতে যুক্তরাষ্ট্রই এখনো মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে। ১৮২৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো, আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদকে ঠেকানোর জন্য ‘মনরো ডক্টরেন’ নামে যে তত্ত্বের সূচনা করেছিলেন, পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন সে তত্ত্বকেই বিশ্বব্যাপী মার্কিন প্রভাব বিস্তারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে। তাদের অন্যায় মোড়লগিরির প্রমাণ ভুরিভুরি। ১৯৪৫ সালে অগাস্ট মাসে দ্বিতীয় মহা সমর যখন শেষ হওয়ার পথে, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র জাপানে দুই দুটি আণবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে কমবেশি দুই লাখ লোককে হত্যা করেছিল, সমাপ্তপ্রায় যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য যার প্রয়োজন ছিল না। বিশ্বের অনেক গুণীজন, বিশেষ করে লর্ড বার্ট্রান্ড রাসেল এবং আণবিক বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনেস্টাইনও ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই মর্মে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক আক্রমণ ছিল অপ্রয়োজনীয়, বরং এটি করা হয়েছিল আণবিক বোমার ধ্বংস ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য। যে আণবিক বিজ্ঞানীর পরামর্শ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ম্যানহাটন প্রজেক্ট দ্বারা আণবিক বোমা তৈরি করেছিলেন, সেই বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনই জাপানে আণবিক বোমা নিক্ষেপের কথা শুনে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের ৯ জুলাই লন্ডনে পাগওয়াশ সম্মেলনে লর্ড বার্ট্রান্ড রাসেল ও আইনস্টাইনের মিলিত বৈঠকেও জাপানে মার্কিন আণবিক আক্রমণের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন উক্ত দুইজন মনীষীসহ আরও অনেকে। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া, চিলি, পানামা, নিকারাগুয়া, গ্রেনেডা, ইরাক প্রভৃতি দেশে আধিপত্য বিস্তারের জন্য কী কী করেছে, তাতো কারো অজানা নয়। তবে ইন্দো-প্রশান্ত প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের সমর্থন আদায়ের জন্যই র্যাববিরোধী সিদ্ধান্ত বলে যারা ভাবছেন তাদের সাথে এজন্য একমত পোষণ করতে পারছি না এজন্য যে বাংলাদেশ এরই মধ্যে অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই ইন্দো-প্রশান্ত এবং বঙ্গোপসাগর সহ সকল সমুদ্রকে সব দেশের জন্য উন্মুক্ত রাখার দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক ফরাসি দেশ ভ্রমণকালে এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এই দাবির সাথে যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্তিত ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা মূলত অভিন্ন, কেননা যেখানে চীন তার নতুন অর্জিত সামরিক শক্তি বলে বলিয়ান হয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে দক্ষিণ চীন সাগরকে তার নিজ এবং একক সার্বভৌমত্বের আওতায় আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাতে পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অর্থে যে বাংলাদেশের জাহাজও নির্বিঘ্নে সে সমুদ্রে যাতায়াত করতে পারবে না, সে সমুদ্রের তলদেশে প্রাপ্ত খনিজ পদার্থ, যা কিনা আন্তর্জাতিক সমুদ্র কনভেনশন “সকল মানুষের সম্পদ” বলে আখ্যায়িত করেছে, তাতে ভাগ বসাতে পারবে না, সে এলাকার সমুদ্রের তলদেশে ক্যাবল বসাতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ‘ইন্দো-প্রশান্ত’ পরিকল্পনার মৌলিক তত্ত্বও হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বেআইনি একচ্ছত্র দাবির বিরোধিতা। সে অর্থে যুক্তরাষ্ট্র ‘ইন্দো-প্রশান্ত’ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের সমর্থন আদায়ের জন্য র্যাববিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। বরং এখন যা জানা গেছে তা হলো- এই যে লন্ডনে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমান নিযুক্ত একটি লবিস্ট ফার্মের দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টার ফলই হচ্ছে এই মার্কিন সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিকের চাপেই এই সিদ্ধান্ত বলে মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সম্প্রতি যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তাও কিন্তু ‘লবিস্ট থিওরি’কে সমর্থন করে। যে ব্যক্তিবর্গ লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তাদের উদ্দেশ্য যে বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং জঙ্গিবাদ রোধে বদ্ধপরিকর সরকারকে বিব্রত করা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সাথে সাথেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কিছু নেতা সেই সিদ্ধান্তের সমর্থনে মত প্রকাশের পর এটি আরো পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তারেক রহমানের নেতৃত্বে নিয়োজিত লবিস্টরাই মার্কিন সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। জানা গেছে রবার্ট মেনেনডাজ, যিনি মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান, তিনি গত দুবছর ধরেই বাংলাদেশের র্যাবের বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে মার্কিন প্রশাসনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এবং এ ব্যাপারে একাধিক চিঠি লিখেছেন। আরো জানা গেছে, যে বাংলাদেশভিত্তিক দুটি সংস্থা বেশ কিছু সময় ধরেই মার্কিন কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে র্যাববিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে। উল্লেখযোগ্য যে এই দুটি সংস্থার একটি হচ্ছে সেটি- যেটি কিনা ২০১৩ সালে ৫ মে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত ইসলামের সমর্থকদের উচ্ছেদের পর এই মর্মে গাঁজাখুরি কথা প্রকাশ করেছিল যে সেদিন বহু ‘হেফাজতি’কে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হত্যা করেছে। যে দাবি ছিল প্রমাণিতভাবেই মিথ্যাচার, যে কারণে সংস্থাটি পেয়েছে গণধিক্কার। আরো জানা গেছে বিদেশে পলাতক কয়েকজন বরখাস্তকৃত সেনা কর্মকর্তা এবং তথাকথিত সাংবাদিক, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতের হুলিয়া রয়েছে, যারা প্রকাশ্যভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী, পাকিস্তানপ্রেমি এবং একই মতবাদে বিশ্বাসী বাংলাদেশে বসবাসরত কয়েকজন মুখ চেনা ব্যক্তিও নিরলসভাবে মার্কিন কর্তৃপক্ষের নিকট উদ্ভট তথ্য সরবরাহ করে যাচ্ছিল। যার ফলেই সাম্প্রতিক এ মার্কিন সিদ্ধান্ত। মির্জা সাহেবরা দাবি করছেন র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। অথচ তার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যে ২০০২ সালে প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়ে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে বিনাবিচারে নিরীহ মানুষদের হত্যাযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার ফলে আইন প্রয়োগকারীরা কয়েক শত মানুষকে হত্যা করেছিল, বিকলাঙ্গ করেছিল, নিরাপরাধ মানুষকে আটক করেছিল, যে কথাগুলো পরবর্তীতে মহামান্য হাইকোর্ট উল্লেখ করেছেন, সে কথা ফখরুল সাহেবরা ভুলে গেলেও দেশের মানুষ ভোলেননি। মির্জা ফখরুল গংদের এটিও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে খালেদা জিয়ার নির্দেশে প্রশাসনিক নির্দেশে সেই অপারেশন ক্লিন হার্ট পালন করতে যেয়ে আইন প্রয়োগকারীরা কয়েক শত নিরাপরাধ লোককে হত্যা, কয়েক শত লোককে পঙ্গু করে, বেআইনি আটক করে দেশে প্রথমবারের মতো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতির সূচনা করেছিল। পরে নিরাপরাধ লোকদের হত্যাকারীদের বিচার থেকে রক্ষা করার জন্য খালেদা জিয়া তার স্বামীর অনুকরণে ২০০৩ সালে একটি ইনডেমনিটি আইনও করেছিল, যেটি পরবর্তীতে হাইকোর্ট বেআইনি করে দেন। সে রায়ে হাইকোর্ট অপারেশন ক্লিন হার্টের আদেশ পেয়ে হত্যা, গুম, নির্যাতন, আটক প্রভৃতির কঠোর সমালোচনা করেন। অপারেশন ক্লিনহার্টের কালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে খালেদা জিয়াও আইনের দৃষ্টিতে হুকুমের আসামি। এই প্রেক্ষিতে মির্জা ফখরুলদের কথা ভূতের মুখে রামের নামেরই মতো।
যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আরও যে তথ্য আমরা পাচ্ছি তা হলো এই যে, বাংলাদেশ থেকে পয়সার বিনিময়ে যারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য পাঠান, তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। তারা তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক অসত্য, উদ্ভট কথা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে থাকেন। এ কারণে অনেক সময়ই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ অনেক সময়ই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
কয়েক মাস আগে খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বলে যে দৃশ্যত অসত্য প্রতিবেদন ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ করেছিল, সেটিও নিশ্চয়ই ঢাকা থেকে সার্থান্বেষীদের পাঠানো মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছিল।
যেসব র্যাব কর্মকর্তা আইন লংঘন করে মানবতাবিরোধী কাজ করেছে তাদের বেআইনি কর্মকাণ্ডের ঘটনা জানার পর সরকার তখনই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এসবের জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের দায়ে র্যাবের কয়েকজন জৈষ্ঠ কর্মকর্তার বিচার এবং সর্বোচ্চ সাজা, লিমনের পায়ে অন্যায়ভাবে গুলি করা কর্মকর্তার শাস্তি এবং লিমনকে ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ আরো কিছু শাস্তিমূলক ঘটনা। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া র্যাবের সফলতার সঙ্গে অপরাধ দমনের পাল্লাটাই অনেক ভারি হবে। অথচ মার্কিন সিদ্ধান্তে এসব হিতকর বিষয়সমূহ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, সম্ভবত লবিস্টরা তা বলেননি এবং ঢাকায় নিযুক্ত তথ্য প্রদানকারীরা এসব কথা গোপন রেখেছে।
এ কথা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে মানবাধিকার অবস্থান সহস্র গুণ শ্রেয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যেভাবে মানবাধিকার দলন করে, তা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। সেখানে মানবাধিকার লংঘনের প্রতিবাদ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাও এ ব্যাপারে তার প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছেন। অতীতে এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে মার্টিন লুথার কিংকে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন দেশে মানবাধিকার লংঘনের অর্থ এই নয় যে আমরা তাকে যুক্তি হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। ‘তুমি অধম, তাই বলে কি আমি উত্তম হবো না’, আমরা সেই নীতিই অনুসরণ করছি গত এক যুগ ধরে। আর একটি কথা না বললেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো, অথচ পাকিস্তানের মতো জঙ্গি পালনকারী রাষ্ট্রে যে সাঈদ হাফিজের মতো আরও অনেক কুখ্যাত জঙ্গি, যারা প্রমাণিতভাবে ২০০৮ সালে মুম্বাই আক্রমণের মুখ্য খলনায়ক ছিল, তাদের ব্যাপারে কিছুই করছে না। সাঈদ হাফিজের খোঁজ প্রদানকারী ব্যক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র পুরস্কার ঘোষণা করেছে। অথচ এই দুর্ধর্ষ জঙ্গি পাকিস্তানে প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে দণ্ডপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী কয়েকজন অবস্থান করলেও সে দেশটি এদেরকে তাদের দেশের ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগ করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে না দিয়ে বরং লালন পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থেই অপরিহার্য। ইন্দো-প্রশান্ত প্রকল্প ছাড়াও আরো অনেক দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উভয় দেশের একত্রে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। তদুপরি তৈরি পোশাক সহ আরো নানাবিধ দ্রব্য আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ হচ্ছে উত্তম সরবরাহকারী দেশ।
বাংলাদেশের বহু মেধাবী ব্যক্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের নাসা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগারসহ বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসাধারণ অবদান রাখছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশকে ক্ষেপিয়ে তুললে এর সবই ভেস্তে যাবে। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু প্রণিত ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- নীতি বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে তা রক্ষা করার দায়িত্ব উভয় দেশের। যুক্তরাষ্ট্র একথাটি ভুলে গেলে সে দেশটিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে, তা ভুলে গেলে চলবে না। আর বাংলাদেশ আগের মতো ভিক্ষার ঝুলি বহনকারী দেশ নয়, এর উন্নয়ন যুক্তরাষ্ট্রসহ সবাইকে অবাক করে দিয়েছে।