ডেস্ক নিউজ
রাশিয়াসহ তিনটি দেশ থেকে ৮ লাখ ৩০ হাজার টন গম ও চাল আমদানি করতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে ওই দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছে বাংলাদেশ। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পর থেকেই রাশিয়া থেকে আমদানি বন্ধ রয়েছে। নতুন চুক্তিগুলো দেশে খাদ্যের মজুদ ও নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করবে। যুদ্ধের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তখন আবশ্যক এসব দানাদার শস্য আমদানি স্বস্তিরও বিষয়।
জানা যায়, গত ২৪ আগস্ট রাশিয়া ও ভিয়েতনাম সরকারের সঙ্গে দুটি বৈঠক করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠকে রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, ভিয়েতনাম থেকে ২.৩ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
এর আগে খাদ্য মন্ত্রণালয় ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সবমিলিয়ে এই তিনটি দেশ থেকে মোট ৮ লাখ ৩০ হাজার টন চাল ও গম আমদানি করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সবগুলো আমদানিই হবে জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) ভিত্তিতে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা এখন দ্রুত চুক্তিপত্র সই করব। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পর পুনরায় রাশিয়া থেকে গম আমদানি শুরু হতে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমদানির উদ্যোগ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখবে। এছাড়া সরকারীভাবে রাশিয়া থেকে আমদানি শুরু হলে পরবর্তীতে বেসরকারী খাতের জন্যও একটা পথ তৈরি হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে, বিশেষ করে গমের। যার প্রভাব পড়ে দেশের বাজারে। একটা পর্যায়ে এসে যখন বিশ্ববাজারে দাম কমতে শুরু করে, তখন শুরু হয় ডলার নিয়ে অস্থিরতা। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কম থাকলেও স্থানীয় বাজারে খাদ্যশস্যের দাম আরেক দফা বেড়ে যায়।
এসব কারণে এখন ৩৮-৪০ টাকা কেজি দরে প্রতিকেজি খোলা আটা ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। গম ও আটার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে রুটি পাউরুটিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের খরচও বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যখন আটার দাম বাড়ে তখন স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভোক্তা চালের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়।
গত বোরো মওসুমে কয়েক দফা বন্যা, পাহাড়ি ঢল ও ঝড়ের কারণে যখন চালের উৎপাদন কমে তখন এর প্রভাব পড়ে বাজারে। একইসঙ্গে, চলতি আমন মওসুমে খরার কারণে উৎপাদন ঘাটতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে প্রতিবছর দেড় কোটি টন চাল উৎপাদন হয়।
এই অবস্থায় দেশের বাজারে কেজিতে ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে মোটা চাল, চিকন চাল মানেই ৭০-৭৫ টাকা। আরও একটু ভাল চাল খেতে হলে এখন সেটা কিনতে হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়।
কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, এ বছর আমনের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তেল ও সারের দাম বৃদ্ধি, ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরা এবং লোডশেডিংয়ের কারণে পর্যাপ্ত সেচ দিতে না পারায় আমনের উৎপাদন সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে।
এ কারণে চাল আমদানিতে সরকার বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ভিয়েতনাম থেকে দ্রুত চাল আমদানি করতে চাচ্ছে। এছাড়াও সরকার বেসরকারী খাতকে ১০.১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু, ডলারের বাড়তি দামের কারণে মাত্র ৪৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। তাই সরকার এখন চালের ওপর থাকা আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে চাইছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এই অবস্থায় উৎপাদন বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এরপর খাদ্যশস্য আমদানি বাড়াতে হবে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য। এই মুহূর্তে রাশিয়া থেকে আমদানি শুরু হলে সেটা অবশ্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তিনি বলেন, সরকারী ও বেসরকারীভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত খুবই সময়োপযোগী।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার ভারতের আরও একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছে, এর মাধ্যমে আরও ১ লাখ টন চাল আমদানি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। এর বাইরে আগামী ২৯ তারিখ মিয়ানমারের সঙ্গেও বৈঠকের কথা রয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, খাদ্যশস্য আমদানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা না থাকার কারণেই রাশিয়া থেকে আমদানি করা যাবে। এজন্য সরকার তরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে আমদানি করতে চাচ্ছে। আগামী মাসেই রাশিয়ান গমের অন্তত দুটি চালান দেশে আনতে চায় সরকার। ভারত থেকে যে চাল আমদানি করা হবে তার ৩০ শতাংশ রেলপথে এবং বাকিটা জাহাজে আনা হবে বলেও জানা গেছে।
বুধবারের সভায় রাশিয়া ও ভিয়েতনামের গম ও চালের দাম কত হবে সেটাও আলোচনা হয়েছে। তবে এখনই দামের তথ্য জানাতে চায় না খাদ্য মন্ত্রণালয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে, দেশের গম আমদানির প্রধান উৎস ছিল- ভারত, কানাডা, রাশিয়া ও ইউক্রেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট গম আমদানি হয় ১,৫৫৮ মিলিয়ন ডলারের। যেখানে ২৪ শতাংশ ভারত, ২৩ শতাংশ কানাডা, ২১ শতাংশ রাশিয়া ও ১৭ শতাংশ এসেছে ইউক্রেন থেকে। কিন্তু, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন এবং রফতানি নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারীভাবে গম আমদানি হয়েছে ৬০ লাখ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ৪৮.৬৪ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারী আমদানিসহ মোট হয়েছে ৪০ লাখ টন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি ব্যাংক সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণীর মাধ্যমে সরকার নতুন আমদানি চালানগুলোর বিপরীতে ডলারে মূল্য পরিশোধ করবে বলে জানা গেছে।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি হওয়ায় এখন ইউক্রেন থেকে নিয়মিত খাদ্যশস্য রফতানি হচ্ছে। এই চুক্তির আওতায়, গত ১ আগস্ট ওডেসা বন্দর ছেড়ে লেবাননের উদ্দেশে ২৬ হাজার টন ভুট্টা নিয়ে যায় একটি জাহাজ। ইউক্রেন থেকে রফতানি শুরু হওয়াকে বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্য আমদানির একটি ভাল সুযোগ হিসেবে দেখছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছে, ইউক্রেন থেকে রফতানি শুরু হওয়াটা আমাদের জন্য ইতিবাচক। এতে করে দেশটির সঙ্গেও আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।