ডেস্ক নিউজ
রাশিয়া থেকে কম দামে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন গম কিনছে সরকার। সরকারী পর্যায়ে চুক্তির ভিত্তিতে (জিটুজি) খাদ্য অধিদফতর রাশিয়ার এই গম কিনছে টনপ্রতি ৪৩০ ডলার দরে। বর্তমান বাজার দর ৩৮০ ডলার। এর পর জাহাজ ভাড়া, ইন্স্যুরেন্স, লোডিং, আনলোডিং সরবরাহকারীর ১০ শতাংশ মুনাফা মিলে আরও একশ’ ডলার হলে টনপ্রতি এর দাম পড়ে ৪৮০ ডলারের মতো। সেখানে সব মিলে সরকার ৪৩০ ডলারে গম ক্রয় করছে। সে হিসাবে টনপ্রতি সরকারের ৫০ ডলারেরও বেশি সাশ্রয় হচ্ছে।
এ বিষয়ে খাদ্য সচিব মোঃ ইসমাইল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গম আমদানির জন্য আমরা ভারত, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রাশিয়া, ইউক্রেনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ভারতে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা রফতানি বন্ধ রেখেছে। ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, কানাড থেকে আনতে টনপ্রতি খরচ ৫০০ ডলারের বেশি হওয়ায় সেখান থেকে সরে এসেছি। তিনি বলেন, কানাডার গম আনতে খরচ পড়বে ৫১০ থেকে ৫২০ ডলার।
অস্ট্রেলিয়ার গম পড়বে ৫০০ ডলার। আর ব্রাজিলের গম আনতে খরচ হবে ৫২০ থেকে ৫৩০ ডলার করে। বেলারুশ গম দিতে চায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার বন্দর ব্যবহার করতে হবে। এতেও খরচ বেশি পড়ে যায়। ইউক্রেনে চিঠি দেয়া আছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া থেকে ৪৩০ ডলারে গম কেনার চুক্তি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাপ্তিসীমা সরবরাহকারী দেশের মূল্য বিবেচনায় সীমিত। সে হিসাবে আমরা বরং কম দামেই গম কিনতে পারছি।
সরকারী পর্যায়ে চুক্তির ভিত্তিতে (জিটুজি) খাদ্য অধিদফতর রাশিয়ার গম কিনছে প্রতিটন ৪৩০ ডলার দরে। সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টন গম কেনার অনুমোদন দেয়, যা ধাপে ধাপে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দেশে আসার কথা।
মজুদ কমে যাওয়ায় সরকার রাশিয়া থেকে গম আমদানি করছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দেশটির (রাশিয়ার) সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যাহত হয়। গত জুলাই মাসে রাশিয়া ও ইউক্রেন খাদ্য রফতানির চুক্তি করার পর ওই অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য রফতানি শুরু হয়েছে।
এ ব্যাপারে খাদ্য সচিব বলেন, আমরা রাশিয়ার কাছ থেকে ২৪ আগস্ট গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওই দিন দাম ছিল ৪৩০ ডলার। সেই দাম ধরেই আমদানির চুক্তি হতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের সঙ্কটের এই সময়ে রাশিয়া আমাদের কাছে ৫ লাখ টন গম রফতানি করবে, এটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সুখবর।
কারণ, সরকারী গমের মজুদ বেশ কমে এসেছে। খাদ্য সচিব আরও জানান, চুক্তি সইয়ের ৪০ দিনের মাথায় রাশিয়ার গমের প্রথম চালান দেশে আসবে। পুরো পাঁচ লাখ টন গম আসবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে।
গম আমদানির সিদ্ধান্তের আগে গত ১১ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দার মান্টিটস্কি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশে গম রফতানির আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এ সময় প্রাথমিকভাবে ৩ লাখ টন গম কেনার বিষয়ে সম্মত হয় দুই দেশ। খাদ্যমন্ত্রী রাশিয়ার গম রফতানির আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সূত্র জানায়, এরপর গত ২৪ আগস্ট রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রফতানিকারক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জেএসসি প্রডিনর্টগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গম আমদানির বিষয়ে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। সেখানে প্রতিটন ৪৩০ ডলারে গম আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্মত হয়।
সবকিছু ঠিক হওয়ার পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিষয়টি সরকারী ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ওঠে গত বৃহস্পতিবার। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানানো হয়, রাশিয়া থেকে সরকারী পর্যায়ে পাঁচ লাখ টন গম আমদানিতে ব্যয় হবে ২১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ২ হাজার ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে)। প্রতিটনের দাম পড়বে ৪৩০ ডলার। প্রতিকেজি গমের মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ টাকা ৮৫ পয়সা।
খাদ্য অধিদফতর জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার রফতানিকারক সংস্থার প্রতিনিধির মাধ্যমে গম কেনার চুক্তি হবে। সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন বলেন, ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি যে দর অনুমোদন দেয়, সেটাই চূড়ান্ত মূল্য। প্রধানমন্ত্রী রবিবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে যে কোন মূল্যে খাদ্যশস্য আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জরুরী প্রয়োজনে পৃথিবীর সকল দেশ প্রয়োজনে বেশি দামে খাদ্য সংগ্রহ করে। পৃথিবীব্যাপী দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় খাদ্য রফতানিকারক দেশগুলো কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশও সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় অধিক দামে হলেও খাদ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিচ্ছে। সে হিসাবে বাংলাদেশ সতর্ক অবস্থানে থেকে সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
জিটুজির মাধ্যমে খাদ্য আমদানিতে বাজার নির্ভর করে রফতানিকারক দেশের ওপর। দেশের স্বার্থে এটি সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্ত। দেশবিরোধী একটি গ্রুপ এর বিরোধিতা করছে। তারা চায় সরকারকে ভুল পথে পরিচালনা করে খাদ্য আমদানি থেকে বিরতি রেখে দেশকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে।
সূত্র জানায়, গত ২৩ আগস্ট রাশিয়ার সঙ্গে জুম মিটিংয়ে গম ক্রয়ের আলোচনা হয়। সেখানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, খাদ্য সচিব মোঃ ইসমাইল হোসেন, বাংলাদেশ নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত, রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। সবার উপস্থিতিতে দরদাম করা হয়। সেখানে খাদ্যমন্ত্রী সুন্দরভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন।
এদিকে আরও কিছু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে গম কিনছে। যেমন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে গত ২৩ আগস্ট জানানো হয়, মিসর রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ২ লাখ ৪০ হাজার টন গম কিনেছে। সব খরচসহ (কস্ট এ্যান্ড ফ্রেইট বা সিএফআর পদ্ধতিতে) দাম পড়েছে ৩৬৮ ডলার।
মিসরের দামটির বিষয়ে বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা বলছেন, মিসরের চেয়ে বাংলাদেশে গম আনার ভাড়া একটু বেশি পড়বে। এ বিষয়ে খাদ্য সচিব বলেন, মিসর থেকে মস্কোর নৌপথের দূরত্ব মাত্র ২ হাজার কিলোমিটার। আর বাংলাদেশের সঙ্গে দূরত্ব ৫ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি।
এছাড়া আমাদের জন্য জাহাজের অনিশ্চয়তা আছে, যেটা মিসরের ক্ষেত্রে নেই। চলমান যুদ্ধের কারণে জাহাজের অনিশ্চয়তা থাকায় জাহাজ ভাড়া ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। সব মিলে খরচ একই রকম পড়বে।
সরকারের গমের মজুদ সামান্য ॥ বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) তথ্য বলছে, দেশে বছরে গমের চাহিদা ৭০ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে ৬০ লাখ টনই আমদানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া মোট গমের ৪৫ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে, ২৩ শতাংশ কানাডা থেকে, ১৭ শতাংশ ভারত থেকে এবং বাকিটা অন্য কয়েকটি দেশ থেকে এসেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশ গমের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ভারত গত মে মাসের মাঝামাঝি নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গম রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর দেশের বাজারে গমের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে।
সরকারী সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন খোলা আটার দাম প্রতিকেজি ৪৭ থেকে ৫২ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে প্যাকেটজাত আটার দাম প্রতিকেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। এ ক্ষেত্রে গত বছরের চেয়ে দাম বেশি ৫৯ শতাংশ।
সরকারের কাছেও গমের মজুদ কম। খাদ্য অধিদফতরের কাছে এখন গম আছে ১ লাখ ৪০ হাজার টনের মতো, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৭ হাজার টন কম। যে কারণে সরকার গম আমদানির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।