ডেস্ক নিউজ
‘বাংলাদেশের জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকে কর্মরত রােজিনা ইসলামকে আমলারা হেনস্তা করেছে। তার
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে অভিযােগ এনে আটক করা হয়েছে।! তিনি একজন নিষ্ঠাবান, সৎ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার সাংবাদিক!’-হয়ত এমন কথাগুলাে বললেই সকলে খুশি হতা। কিন্তু সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা ও নৈতিকতা সেই শিক্ষা দেয়না। মনে রাখা উচিত, অনেক গুপ্তচর সাংবাদিকের লেবাস নিয়ে কাজ করলেও সাংবাদিকেরা কখনাে গুপ্তচর হয় না। তাদের কোন ব্যক্তিগত লাভ থাকতে নেই। বলা হয়ে থাকে, সাংবাদিকের কোন বন্ধু থাকতে নেই।
বাংলাদেশে করােনা পরিস্থিতিতে সবচাইতে টালমাটাল একটি মন্ত্রণালয়ের নাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বর্তমান সময়ে সকল দেশের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও এটি। সেই মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অন্যায়ের কথা প্রচার করা প্রত্যেক সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব। কিন্তু মহামারীর কারণে দেশের এই দুর্দিনে মন্ত্রণালয়কে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠা কোনভাবেই কোন সাংবাদিকের কাম্য নয়। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছি। এমনও অনেক প্রতিবেদন করা হয়েছে। যার কারণে দেউলিয়া হয়ে গেছেন দুর্নীতিগ্রস্ত অনেকে। ব্যক্তি আক্রোশ থেকে নয়, কোন রাজনৈতিক দলের ইন্ধনেও নয় এবং কোন বিদেশি গােয়েন্দা সংস্থার মদদপুষ্ট হওয়ার জন্যও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
লিখনি। লিখেছি পেশাগত দায়বদ্ধতার স্থান থেকেও। রােজিনা ইসলামকে তার প্রতিবেদনগুলাোর জন্য ধন্যবাদ। এমন প্রতিবেদন লেখার ক্ষমতা থাকাটা নিশ্চিতভাবেই প্রশংসা পাবার যোগ্য। কিন্তু প্রতিবেদনগুলাে তিনি দেশ ও জনগণের স্বার্থে করেছেন, নাকি ব্যক্তিগত স্বার্থে?
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সবচাইতে বড় সমস্যা হলাে, বস্তুনিষ্ঠতা বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত লাভ নির্ভর অথবা ‘নায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সাংবাদিকতা করা। একজন সাংবাদিক শুধুই একজন সাংবাদিক। তার অন্য কোন পরিচয় থাকতে নেই। থাকবে না আমলা বন্ধু। সে আসলে তার পেশাগত কাজের জন্য দিন শেষে সকলের বন্ধু এবং সকলেরই চক্ষুশূল হবেন। তাকে সাহায্য করতে কখনাে কোন আমলা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দ্বারস্থ হতে হবে না। সাংবাদিকতাই তার জন্য যথেষ্ট। কেননা তিনি একজন প্রকৃত সাংবাদিক। কিন্তু রোজিনা ইসলাম গ্রেফতারের পর নিজের দোষ স্বীকার করে আমলাদের কাছে মুচলেকা দিতে চেয়েছেন। সহায়তার জন্য নিজ পত্রিকার এডিটরকে নয়, বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন দিতে চেয়েছেন! কেনাে?
একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি যদি এসাইনমেন্টে থাকেন, তাহলে তার কাজের সকল দায় তাে অফিসের। তাকে অফিস ছাড়া আর কারাে দ্বারস্থ হবার প্রয়ােজন নেই। আর তার অফিস যদি তাকে এই এসাইনমেন্ট দিয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তাকে মুক্তি দিয়ে অফিসের সেই ব্যক্তিকে জবাবদিহিতার জন্য আনা উচিত, যার নির্দেশে তিনি এই কাজটি করেছেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে রােজিনার এই কাজের কথা তার অফিস জানতাে কিনা, সেবিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। ব্যক্তিগত কাজের তথ্য সংগ্রহ করতে। তার সেই ব্যক্তিগত কাজটি কি ছিলাে?
রােজিনা ইসলামের কারণে বাংলাদেশ কী ধরণের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছিলাে সে কথার ইঙ্গিত কিছুটা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. জাহিদ মালেক। তিনি কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, এই তথ্য ফাঁস হলে চীন
বাংলাদেশকে টিকা দিতাে না। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, মামলার এজাহারে এই গােপন নথির কোন বর্ণনা নেই কেনাে?’ তারা আসলে একজন সুনাগরিক কিনা সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ রয়েছে, সাংবাদিকতা তাে অনেক পরের বিষয়।
যেই নথি প্রকাশ করলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে, যেই নথি প্রকাশ করলে বাংলাদেশকে স্বল্পমূল্যে টিকা প্রদানকারী দেশগুলাের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হবে এবং বাংলাদেশের জনগণ টিকা পাবে না; এমন এক নথি মামলার এজাহারে জুরে দেয়া গেলে রােজিনা ইসলামকে আটকেরই প্রয়ােজন ছিলাে না। কেননা সেই তথ্য তখন বাজারের সবচাইতে কম দামি পত্রিকাতেও থাকতে পারতাে।
রােজিনা ইসলামকে ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে তার গলাটিপে অত্যাচারের যেই কথা শােনা যাচ্ছে, এই কথা শুনে হয়ত রােজিনা ইসলাম নিজেও হাসবেন। কেননা আসল সত্যটি যে তার থেকে অনেক ভিন্ন! রােজিনা ইসলামের মত একজন সাংবাদিক এভাবে নথি সংগ্রহ করছেন তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানাের পর কি হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে আমলাদের লেগেছে ৫ ঘণ্টা। এটা অবশ্য এদেশের আমলা সমাজের প্রাচীন অভ্যাস। কিন্তু বিষয়টি রাষ্ট্রর জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে এতো সময় লাগাটা নিশ্চিতভাবেই আমলাদের জন্য দুর্বলতা বটে। আর আমলাদের আচরণ নিয়ে সমালােচনা রয়েছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। বিষয়টি নতুন নয়। কিন্তু অনেকেই যে বিষয়টি জানেন না, তা হলাে রােজিনা ইসলাম ও তার স্বামীর আয়ের মূল উৎস।
আমাদের দেশের অধিকাংশ সাংবাদিকই সৎ থাকার কারণে বেশ কষ্ট করে চলে তাদের সংসার।সবচাইতে সিনিয়র সাংবাদিকদেরও বেতন হয় লাখের কাছাকাছি। সেখানে নিজ বাড়িতে এ স্বাচ্ছন্দ্যে কিভাবে থাকেন রােজিনা ইসলাম ও তার স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু? রােজিনা ইসলামের স্বামী মিঠুর তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ আরাে বেশ কিছু মন্ত্রণালয় থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ নেন মিঠু। তার প্রতিষ্ঠান তিনটির নাম হলাে ওয়ান কনস্ট্রাকশন, আরএম এন্টারপ্রাইজ এবং এস এস নেটওয়ার্ক। সম্প্রতি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে এই তিনটি
প্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারের মাধ্যমে ১০ কোটি টাকার কাজ আদায় করে নেয়। কিভাবে? সেটি একটি প্রশ্ন।
একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক হিসেবে রােজিনা ইসলাম নিশ্চয়ই ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট সম্পর্কে বােঝেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রতিবেদন করা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন্দ্রিক সাংবাদিকতা করা অবস্থায় তার স্বামীর নিয়মিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে কাজ নেয়া নিশ্চিতভাবেই
কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট । নৈতিকভাবে এটি সম্ভব নয়। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্য এই অভিযােগগুলাে নতুন নয়। পদ্মাসেতু দুর্নীতি নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলা এই রােজিনা ইসলাম যখন পদ্মা সেতু দুর্নীতি নিয়ে রিপাের্ট করা বন্ধ করেন, তার কিছুদিন পরেই তার স্বামী মিঠু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কোটি টাকা মূল্যের কাজের টেন্ডার পান। একই চিত্র ছিলোে শাহজাহান খান যখন নৌ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। যারা আন্দোলন করছেন, তাদের অনেকেই জানানে সচিবালয়ে রােজিনা ইসলাম কেনাে ত্রাস ছিলাে। তিনি কতটি দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করতেন, কতগুলাে ছাপার জন্য জমা দিতেন, আর কতগুলাে
ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন? শৈশব থেকে সুনাগরিকের বর্ণনায় পড়েছি ব্যক্তি স্বার্থ থেকে জাতি স্বার্থ আগে। কিন্তু রােজিনা ইসলামের
পক্ষে অবস্থান নিয়ে আমরা আসলে না নিজ সাংবাদিক জাতের ভালাে করছি, না রাষ্ট্রের। নিজেদের সুনাগরিক দাবি করা আমরা সাংবাদিকরা প্রথম রোজিনার মুক্তির জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছি, এরপর আইনমন্ত্রীর। আদালতের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছি, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেই আসলে ব্যর্থ হিসেবে বিশ্বের বুকে উপস্থাপন করেছি আমরা। অথচ একবারও বােঝার চেষ্টা করিনি সার্বিক অবস্থা। রােজিনা ইসলামকে হেনস্তা করে যদি আমলারা সাংবাদিক সমাজের ক্ষতি করে থাকে এবং সেই জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করে আমলাদের শাস্তি পেতে হয়, তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ইমেজের যেই বারােটা আমরা বাজিয়েছি তার মূল্য কে চোকাবে?
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের টিকা উৎপাদনের চুক্তি বিষয়ক ফাইলের ৬২ পেজের যেই তথ্যের ছবি তুলেছিলেন রােজিনা ইসলাম সেখানে বড় করেই লেখা ছিলাে এই তথ্য প্রকাশিত হলে চুক্তি বাতিল হবে । এই লেখা দেখার পরও সেই তথ্য নিয়ে পত্রিকায় ছাপিয়ে তিনি দেশ ও জাতির কত বড় উপকার করতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে সাংবাদিকদের-ত বটেই, বরং সাধারণ মানুষেরও প্রশ্ন তােলা উচিত। বাংলাদেশে যখন টিকা সরবরাহ নিয়ে সকলে দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে, তখন দেশে করােনার টিকা উৎপাদন হলে তা দেশের অর্থনীতি ও টিকা সরবরাহ উভয় ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আর সেটি যদি বন্ধ হয়ে
যায়, তাহলে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য এক অচলাবস্থা। রােজিনা ইসলাম কী তাহলে সেটাই চেয়েছিলেন? তিনি কী চান না, এই দেশের সকল মানুষ স্বল্পমূল্যে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তার পাশের দোকানটিতেও করােনার টিকা লাভ করুন? জনকল্যাণে যদি সাংবাদিকতা না হয়, তাহলে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের রাষ্ট্রে প্রয়ােজনীয়তাটা কী? শুধু তথ্য সরবরাহ করে দেশকে অস্থিতিশীল করাই কী তবে সাংবাদিকতা?