পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে চলছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ। ২০২৩ সালেই যেন এখানকার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে যেতে পারে, সেই লক্ষ্যে চলছে কার্যক্রম। সংশ্লিষ্টদের আশা এটি একদিকে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করবে অন্যদিকে দ্বিগুণের বেশি অভ্যন্তরীণ রিটার্ন দেবে সরকারকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ৯০ শতাংশ রাশিয়ার ঋণ, বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় করবে বাংলাদেশ সরকার। উৎপাদনে গেলে রাশিয়াকে প্রতি বছর ঋণ শোধ করতে হবে ৫৬৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ৫৬ কোটি ডলার। এত বড় অংক দেখে কেউ কেউ এটিকে সাদা হাতির প্রকল্প বলছেন। কিন্তু এমন অভিযোগ নাকচ করে সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা শ্বেত হস্তীর প্রকল্প নয়, বরং উন্নয়নের মাইলফলক।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পের দুটি রিঅ্যাক্টর চালুর পর প্রতি বছর কিস্তি পরিশোধ করতে হবে (৫৬ কোটি ডলার)। প্রকল্পের রিটার্ন থেকে কিস্তির অর্থ উঠে এলে ভর্তুকির দরকার পড়বে না।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর অভ্যন্তরীণভাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে রিটার্ন আসবে সাড়ে ৯ শতাংশ। প্রকল্প ঋণের সুদ ১ থেকে ২ শতাংশের বেশি হবে না। তার মানে বাংলাদেশ এই প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক লাভবান হবে। তাহলে এটা সাদা হাতি কীভাবে হলো? মানুষজন কেন বা কীভাবে এটাকে এভাবে বলছেন বুঝি না। প্রকল্পে বাৎসরিক রিটার্ন সুদের হার অনেক কম। আমরা এ প্রকল্প নিয়ে কোনো বিপদে পড়বো না। ঋণ বছর বছর ফিরিয়ে দিতে পারবো। অভ্যন্তরীণ রিটার্ন দ্বিগুণের বেশি। ঋণটা নিচ্ছি ২৮ বছরের। গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩৮ বছর হাতে সময় পাবো। আমরা এটা দিতে পারবো। তাছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের জন্য রূপপুরের কোনো বিকল্প নেই।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, প্রকল্পের দুটি রিঅ্যাক্টর থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, যার সমান ২৪ লাখ কিলোওয়াট বা ইউনিট। এক ইউনিট বিদ্যুৎ যদি পাঁচ টাকায় বিক্রি করা হয়, তাহলে এক ঘণ্টায় আয় হবে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। একদিনে ২৪ ঘণ্টা হিসেবে দৈনিক আয় আসবে ২৮ কোটি ৮০ লাখ। বছরে ১০ হাজার ৫১২ কোটি আয় হবে। যদি ডলার হিসাব করা হয়, তাহলে বার্ষিক আয় দাঁড়াবে এক হাজার ২৩৬ মিলিয়ন ডলার, যেখানে ঋণ শোধ করতে হবে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় হবে সাড়ে ৪ থেকে ১১ দশমিক ২ মার্কিন ডলার এবং মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন ব্যয় হবে প্রতি মেগাওয়াটে ৮ থেকে ১৪ ডলার। এই দুই ধরনের ব্যয় মিলিয়ে প্রতি মেগাওয়াটে গড় খরচ হবে ১৬ থেকে ১৮ ডলার। এর বেশি হবে না, কারণ ভিভিইআর-১২০০ সবচেয়ে আধুনিক রিঅ্যাক্টর এবং রাশিয়ান জ্বালানি তুলনামূলক সস্তা। প্রতি মেগাওয়াট ১৮ ডলার হিসাবে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াটে এ খরচ হবে ৩৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা ঘণ্টায়। এক বছরে খরচ হবে ৩৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে না গিয়ে যদি ৯০ শতাংশও উৎপাদন হয়, তাহলে এর ব্যয় কমে দাঁড়াবে ৩৪০ মিলিয়ন ডলারে। পাশাপাশি আয়ও কমে দাঁড়াবে এক হাজার ১১২ মিলিয়ন ডলারে। এ হিসাবে বছরে প্রকল্প থেকে মোট আয় হবে এক হাজার ১১২ ডলার এবং ব্যয় হবে ৩৪০ মিলিয়ন ডলার। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে বছরে ৭৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় থাকবে প্রকল্প থেকে।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছর কমপক্ষে ৭৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভ হলে ৫৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কেন পরিশোধ করতে পারবে না এই প্রকল্প? এভাবে ২০ বছরে কিস্তি পরিশোধ করেও প্রতি বছর ২০০ মিলিয়ন ডলার লাভ হবে। এই ১২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প থেকে ৬০ বছরে রিটার্ন আসবে ৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া ৬০ বছর পরও আপগ্রেড করে চালানো যাবে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রকল্পটির কারণে যে দীর্ঘমেয়াদি পাওয়ার সোর্স পাওয়া যাবে, তাতে যেমন টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভর জ্বালানি থেকে তৈরি বিদ্যুতের অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচা যাবে, তেমনি এ প্রকল্প ঘিরে যে বড় আকারের দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খুলছে, সেটাও সুদূরপ্রসারী ফল দেবে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, রূপপুর সাদা হাতি নয়, এটাকে বরং দেশ গঠনের হাতি বা উন্নয়নের হাতি বা সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলের হাতি বলতে পারেন। ফসিল ফুয়েল আর কত দিন চলবে? গ্যাস বা তেল পুড়িয়ে একদিকে যেমন জলবায়ুর ক্ষতি করছি, অন্যদিকে এটা কত দিন মিলবে তা নিয়েও ঝুঁকি আছে। এসব কারণেই আমাদের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণ করতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা সব বিষয় চিন্তা-ভাবনা করেই প্রকল্প গ্রহণ করি। আবেগ দিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করি না। মানুষের ভাগ্য বদল দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করেই প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পটি একদিকে যেমন ভালো রিটার্ন আসবে অন্যদিকে দেশের আর্থ-সামাজিক আমূল পরিবর্তন হবে। আপনারা দেখেন রূপপুরে মানুষের কীভাবে ভাগ্য বদল হচ্ছে। সবাই কাজ করে খেতে পারছে। এটা দারুণ অর্থনৈতিক বিপ্লব এখন দেখতে পাচ্ছি রূপপুরে।