নিউজ ডেস্ক:
কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। দিন যত যাচ্ছে ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে এই উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। এলাকার পরিবেশ কলুষিত করার পাশাপাশি তারা ইয়াবা ব্যবসা, আগ্নেয়াস্ত্র ও মানব পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাড়ার পর ইয়াবার কারবার বেড়ে গেছে।
এ কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও কারবারি ধরা পড়েছে। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোকে ব্যারিকেডের আওতায় আনা না গেলে বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটননগরী কক্সবাজারের পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের আসার পর শরণার্থী অধ্যুষিত কক্সবাজার জেলায় ইয়াবা আটকের পরিমাণ বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়ে গেছে মাদক মামলা ও আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যাও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বছরের তুলনায় পরের বছর প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক ইয়াবা উদ্ধার বা আসামি গ্রেপ্তারের তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক সৌমেন মণ্ডল বলেন, মামলার পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়, রোহিঙ্গারা আসার পর মাদক চোরাচালান আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। টেকনাফ থানার অফিসার ইন চার্জ প্রদীপ কুমার দাস মুঠোফোনে বলেন, কয়েকদিন আগে লেদা ক্যাম্প থেকে একটি রোহিঙ্গা শিশুকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে আসছিল অপহরণকারীরা। শিশুটিকে উদ্ধারে এবং অপহরণকারীদের ধরতে অভিযান চালিয়ে আসছিল পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে লেদা ক্যাম্পের পেছনে পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালানোর সময় বন্দুকযুদ্ধে ৩ রোহিঙ্গা নিহত হয়।
নিহতরা হলেন লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আজিজুর রহমানের ছেলে হাবিব (২০), উখিয়ার থাইংখালী ক্যাম্পের নুর মোহাম্মদের ছেলে সামশুল আলম (৩৫) এবং মুক্তার আহমেদের ছেলে নুরুল আলম (২১)। পুলিশের অভিযানে অপহূত শিশুটিও উদ্ধার হয়েছে। তিনি আরো জানান, গত এপ্রিল মাসেও আরেকটি রোহিঙ্গা শিশুকে অপহরণ করে হত্যার ঘটনায় বন্দুকযুদ্ধে আরো ৩ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিলেন। এছাড়া ইয়াবা পাচারকালেও বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
এ দিকে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, টেকনাফ, উখিয়া, রামু, সদরসহ জেলার আট উপজেলায় ২০১৬ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে এক হাজার ১২৫ জনকে আসামি করে ৬৬৯টি মামলা হয়েছে। ২০১৭ সালে এ ধরনের মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ১৩৭। ২০১৮ সালে ২ হাজার ৮৮৯ জনকে আসামি করে এক হাজার ৮২৪টি মামলা হয়।
সূত্রমতে, দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের উৎপাত ততই বেড়ে চলেছে। অপহরণ, চুরি, ছিনতাই ডাকাতি, ইয়াবা ব্যবসা, আগ্নেয়াস্ত্র আনাসহ সব ধরনের অপরাধ বাড়ছে কক্সবাজারজুড়ে। দিন দিন এদের পরিধি বেড়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
সূত্রমতে, গত ২৮ মে বান্দরবানে রোহিঙ্গা নারীকে পাসপোর্ট করাতে এসে দালাল ও গ্রাম পুলিশসহ ৬ জন আটক হয়েছে।
আটকরা হলেন— রোহিঙ্গা নারী সাইকা, সৈয়দ আলম, এলম খাতুন ও রাজিয়া বেগম এবং দালাল জাকারিয়া ও গ্রাম পুলিশ চৌকিদার আবদুল মালেক।
পুলিশ জানায়, বিকালে দালাল জাকারিয়া ও গ্রাম পুলিশ আবদুল মালেক রোহিঙ্গা নারী সাইকাকে রাজিয়া বেগম সাজিয়ে বান্দরবান পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করাতে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাদের আটক করে।
পুলিশ আরও জানায়, এ ঘটনায় নাইক্ষ্যংছড়ির আসল রাজিয়া বেগম, তার বাবা সৈয়দ আলম ও মাতা এলম খাতুনকে আটক করে বান্দরবান থানায় নিয়ে যায়। বান্দরবানের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, রোহিঙ্গা নারী সাইকা মায়ানমারের রাখাইনের মুংডু জেলার গুচিজন থানায় তার বাড়ি। মালয়েশিয়া যাবার জন্য পাসপোর্ট করাতে বান্দরবানে এসেছিল। কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালীর চাকমার কুল শরণার্থী ক্যাম্পের শরণার্থী তিনি। তার কাছে শরণার্থী কার্ডও রয়েছে।
একই দিন কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে তিন কেজি চোরাই স্বর্ণ ও তিন লাখ টাকাসহ তিন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। আটকরা হলেন উখিয়ার বালুখালী ৯নং ক্যাম্পের সি ব্লকের মৃত নুর আহামদের ছেলে আজিজ (১৮), সি-১৩ ব্লকের ইলিয়াছের ছেলে নুরুল হাসেম (২৮) ও সি-৭ ব্লকের আবুল কাসেম (২২)।
উখিয়া থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ আবুল খায়ের বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে স্বর্ণ এনে ক্যাম্পভিত্তিক সিন্ডিকেটগুলো স্বর্ণ ব্যবসা চালিয়ে আসছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উখিয়া-টেকনাফের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ানের নেতৃত্বে থানা পুলিশ বালুখালী ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে এ বড় চালানটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
এ সময় উখিয়া থানা পুলিশের ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার, এসআই প্রভাত কর্মকারসহ অন্যরা সঙ্গে ছিলেন। ওসি আরও জানান, আটকদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় কক্সবাজারের যে এক হাজার ১৫২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, তাদের ৯১২ জনই টেকনাফের। ইয়াবার প্রবেশদ্বার খ্যাত সীমান্তবর্তী এই উপজেলায়ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির পর ইয়াবা আটকের পরিমাণ বেড়েছে। স্থানীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইতোমধ্যে একাত্ম হয়েছে।
তাদের দাবি, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়া হোক। নইলে এরা যত্রতত্র বেরিয়ে এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। আদমপাচার, মাদক ব্যবসা, চুরি ছিনতাইসহ নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এদের অব্যাহত অপতৎরতায় স্থানীয় বাসিন্দারা রীতিমতো তটস্থ। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।