নিউজ ডেস্ক: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের লক্ষ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর দ্বারা ক্রমাগত অত্যাচার-নিপীড়ন চালায় সে দেশের সরকার। অমানবিক নির্যাতনের ফলে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কয়েক দফায় প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
প্রথম দিকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাঙালি দাবি করে রাখাইনে ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপে সে অবস্থান থেকে সরে আসেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি। পরে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত নিতে জাতিসংঘ এর সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করা হয়। যা আনান কমিশন নামে পরিচিতি লাভ করে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আনান কমিশন ৮৮টি সুপারিশ করে। যার অর্ধেকও বাস্তবায়ন করেনি মিয়ানমার সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে সুপারিশ বাস্তবায়নের নামে মিথ্যাচার করছে মিয়ানমার সরকার। তাদের দাবি, কমিশনের ৮১টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করছে মিয়ানমার। যা কেবল মিথ্যাচার।
রাখাইন রাজ্যের সব নাগরিকের উন্নয়ন, নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক বিষয়াদির উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে এবং গ্রামগুলোতে স্থিতিশীলতা ব্যবস্থাপনা ও উদ্বাস্তুদের জন্য শরণার্থী শিবির সরিয়ে ফেলতে কাজ করবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে দেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী যাচাই কার্যক্রমে গতি আনতেও কাজ করার কথা এ কমিটির।
গত বছরের ১৮ আগস্ট জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান মারা যাওয়ার তিন দিন পরে মিথ্যাচার শুরু করেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। বলা হয়, কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের ৮৮টি সুপারিশের ৮১টিই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এ সংক্রান্ত মিথ্যাচারের সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে ২১ আগস্ট থেকে সু চিকে উদ্ধৃত করে প্রচার করা হয়, ‘রাখাইন রাজ্যে টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ড. কফি আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশের মধ্যে এ যাবত ৮১টিই আমরা বাস্তবায়ন করেছি।’
তৎক্ষণাৎ আনান কমিশনের অন্যতম সদস্য নেদারল্যান্ডসের সাবেক রাষ্ট্রদূত লেসিসা ভ্যান ডেন আসুম এক টুইট বার্তায় লিখেছিলেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসার কারণগুলো এখনো সমাধান হয়নি।
জানা যায়, রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের বার্ষিকীর প্রাক্কালে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন বিষয়ে সু চি ওই মিথ্যাচার করেন সিঙ্গাপুরে বসে। দৃশ্যত তিনি চাপ এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে সু চি বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক সংকটের সূত্রপাত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে। সেই ঝুঁকি আজও আছে এবং তা বাস্তবসম্মত।
এদিকে আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মিয়ানমার সরকার এগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেনি। সুপারিশগুলোর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৮২ সালের নাগরিক আইন পর্যালোচনা। মিয়ানমার এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে আগের মতোই রোহিঙ্গাদের ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি)’ গ্রহণের ওপর জোর দেয়।
গত বছরের ২৭ জুন রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে ডেনমার্কে পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে মিয়ানমারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীনতা দূর করতে নাগরিকত্ব আইন পর্যালোচনার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে না। গত জুন মাসের শুরুর দিকে ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া পাঁচজন ব্যক্তি রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমার যে উদ্যোগ নেয়নি তা গত বছরের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বক্তব্যেও স্পষ্ট। গত ৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট মিয়ানমারকে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার পূরণ করার আহ্বান জানান।
গত ৮ আগস্ট ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপি এক যৌথ বিবৃতিতে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যে সংকটের মূল কারণগুলো সমাধানের আহ্বান জানায়।
তা ছাড়া গত ১১ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য সফর করে আসা বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের মাধ্যমে জানা গেছে, দুটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও কয়েকটি ঘরবাড়ি বানানো ছাড়া মিয়ানমার দৃশ্যমান আর কিছুই করেনি।
এদিকে ‘ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের’ সহ-প্রতিষ্ঠাতা মং জার্নি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তুরস্কের আনাদুলু এজেন্সিতে এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, ‘সু চি মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে মার্জিত মুখপাত্রে পরিণত হয়েছেন। চলুন আমরা সবাই মিয়ানমারের মিথ্যা আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করি। আর সু চিকে দিয়েই আমরা তা শুরু করি।’