ডেস্ক নিউজ
আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মহাপরিকল্পনা ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি বাস্তবায়িত হলে উপকূলে নতুন ভূমি জাগবে। দেশের আয়তন বাড়বে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ কোটি টাকা। প্ল্যান বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চেয়ারপারসন করে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। কাউন্সিলে সদস্য রয়েছেন কৃষিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী। এছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রী, নৌ পরিবহনমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, পানিসম্পদ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীকেও সদস্য করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) এই কাউন্সিলের সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। বন্ধ হবে নদীভাঙন। উপকূল এলাকায় নতুন ভূমি জাগবে। দেশের আয়তন বাড়বে। শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানসহ সার্বিক জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। উন্নত দেশের রূপকল্প ২০৪১ মাথায় রেখে এই মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। এই মহাপরিকল্পনায় যুক্ত রয়েছে রূপকল্প-৪১ এর খাদ্য নিরাপত্তা কৌশল, অবকাঠামো ও শিল্প উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রণীত কাঠামো।
সূত্রমতে, দীর্ঘমেয়াদি এ কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়নে ইউরোপের দেশ নেদারল্যাল্ডসের ব-দ্বীপ পরিকল্পনাকে মডেল হিসেবে নেওয়া হয়েছে। কারণ এই দেশটিতেও রয়েছে অনেক নদ-নদী। তারা এই পানিসম্পদ ব্যবহার করেই এতটা উন্নতি লাভ করেছে। ইউরোপের এই দেশটির আদলে এ মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ. কে. এম. এনামুল হক শামীম সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এবং নদীমাতৃক দেশ। এই ব-দ্বীপ ঘিরেই সামগ্রিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের লক্ষ্যে শত বছরের মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। এর নাম বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা। পরিকল্পনার প্রথম ধাপে নদী ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ এবং নদী-সাগর থেকে ভূমি উদ্ধার করে দেশের আয়তন বাড়ানোর মতো তিনটি কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
উপমন্ত্রী আরও জানান, উন্নত দেশের স্বপ্ন পূরণে রূপকল্প-৪১ বাস্তবায়নে কৃষি খাতের উন্নয়ন জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিল্প খাতের উন্নয়ন করে সকলের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসার, সকলের জন্য সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, পরিবেশ উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ভূ-প্রতিবেশ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে ব-দ্বীপ মহাপরিকল্পনায়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় ২০৩০ সাল নাগাদ প্রথম পর্যায়ে ছয়টি হটস্পট ঠিক করে ৮০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে ৬৫টি প্রকল্প ভৌত অবকাঠামো, ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং গবেষণা সংক্রান্ত।
পরিকল্পনায় তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য পুরোপুরি দূর করা হবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের মর্যাদা লাভ করবে। এজন্য অর্থনীতি ও সামাজিক খাতের যেসব সূচকে যে পরিমাণ অগ্রগতি দরকার তা অর্জন করতে হবে।
সমীক্ষা কার্যক্রম ও গবেষণা কাজের জন্য নেদারল্যান্ডস সরকার ইতোমধ্যে ৪৮ কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে। তবে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৩৩টি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) এই ডেল্টা প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া হয়। এই পরিকল্পনার অধীনে আপাতত ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য ৮০টি প্রকল্প নিচ্ছে সরকার। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা এবং ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শুরুতেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। পরিকল্পনার মাধ্যমে বন্যা, নদীভাঙন, নদীশাসন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামের পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নগরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কশন ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণ জরুরি। যদিও এটি আগামী একশ’ বছরের পরিকল্পনা, আপাতত ২০৩০ সাল নাগাদ ৮০টি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এতে খরচ হবে ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। বর্তমান বাজার ধরে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া বাংলাদেশের আয়তন বাড়বে। এক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ডেল্টা পরিকল্পনার মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের ভূমি বাড়ছে। নেদারল্যান্ডস এ পর্যন্ত ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি পেয়েছে। বাংলাদেশও নদীবাহিত পলি দিয়ে এমনভাবে ভূমি পেতে পারে।
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে ২৬টি গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নদী নাব্য ফিরে পাবে। পরিকল্পিতভাবে নদীগুলোতে নাব্য রাখতে পারলে দেশে আর বন্যা থাকবে না। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সেজন্য এখন থেকেই অর্থের উৎস ঠিক করে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ২১০০ সালে বাংলাদেশ কোন জায়গায় থাকবে তা বদ্বীপ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। পৃথিবীতে এত দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা আর কোনো দেশ করেনি। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারলে কৃষিতে আরও এগিয়ে যাবে দেশ। বদ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় ছয়টি অঞ্চলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এগুলো হলো- উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নদীবিধৌত অঞ্চল ও নগর এলাকা।আমার রাজশাহী