ডেস্ক নিউজ
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অসহায় দরিদ্ররা পাচ্ছেন বিনামূল্যে ব্যয়বহুল চিকিৎসা সেবা। কোন কোন রোগীর বিদেশে তিন/চারটা অপারেশনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা পেতে কোটি টাকার বেশি খরচ হতো। কিন্তু সেসব রোগীরা এখানে বিনামূল্যে বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন।
ঘটনা-দুর্ঘটনায় বিকলঙ্গ, ব্রেস্ট ক্যান্সারসহ নানা ধরনের ক্যান্সার, ঠোট কাটা, তালু কাটাসহ জন্মগত শারীরিক ত্রুটি, পোড়া রোগীসহ সব ধরনের জটিল রোগীকে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর ৫০০ বেডের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট উদ্বোধন করা হয়। পূর্ণাঙ্গ এই হাসপাতালে অত্যাধুনিক চিকিৎসা সেবা ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষার সর্বোত্তম মান নিশ্চিত করতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চিকিৎসা ও রোগীর সুবিধা ও ব্যবস্থাপনা নির্বিঘ্ন রাখতে ভবনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পরিবেশ, হেলিপ্যাড এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। হাসপাতালের পরিবেশও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। চিকিৎসাধীন রোগীরা বলেন, এমন একটি ইউস্টিটিউট না থাকলেও জীবনে চিকিৎসা সেবা পাওয়া অসম্ভব ছিল। ১০ হাজার টাকা এক সাথে করার সামর্থ্য নেই, বিদেশে কোটি টাকার চিকিৎসা সেবা নেবো কিভাবে?
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগী। ছবি : আবদুল গণি
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আইসিইউ বেড আছে ২০টি। ৬০টি এইচডিইউ শয্যা আছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন চাঁনখারপুলে নির্মিত এটি পৃথিবীর বৃহৎ পূর্ণাঙ্গ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। সরকারি খরচে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য বিশ্বের কোথাও এমন বার্ন ইনস্টিটিউট নেই, এটিই প্রথম। গতকাল এই প্রতিনিধি সরেজমিন এই হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক, রোগীদের সঙ্গে আলাপ করেন এবং হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখেন। সারা দেশ থেকে প্রতিদিন বহির্বিভাগে প্রায় এক হাজার রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। জরুরি বিভাগে অর্ধশতাধিক রোগী আসেন। রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকেও রেফার হয়ে প্রতিদিন দুই শতাধিক রোগী এই ইনস্টিটিউটে আসছেন। পোড়া রোগীদের ৯৯ ভাগেরই প্লাস্টিক সার্জারির প্রয়োজন হয়। এটা খুবই ব্যয় বহুল। বিদেশে একজন পোড়া রোগীর প্লাস্টিক সার্জার করতে পাঁচ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। যা দেশের দরিদ্র মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ক্যান্সারসহ সব ধরনের জটিল সার্জারি করা হয়। মুখমন্ডলের ও স্তন ক্যান্সারসহ বিভিন্ন অঙ্গের ক্যান্সার অপারেশন করে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। কোন কোন রোগীর কয়েক দফা অপারেশন করতে হয়। বিদেশে যার ব্যয় কোটি টাকার উপরে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সব ধরনের রোগী আসেন, তবে আগত রোগীদের মধ্যে দরিদ্র রোগীর সংখ্যা বেশি। গাইনি সার্জারির জন্য পৃথক বিভাগ আছে। অন্তঃসত্ত্বা মহিলা পোড়া গেলেও চিকিৎসা পাচ্ছেন এখানে। হ্যান্ড সার্জারি করে প্রচুর রোগী ভালো হয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছেন। অনেকের শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত আছে, বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করেও তা ভালো হয়নি। কিন্তু শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা সেবা নিয়ে তারা সুস্থ হয়ে গেছেন। হাইফার ব্রেরিক অক্সিজেন থেরাপি দিয়ে সুস্থ করা হয়। এটা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ছাড়া দেশের কোথাও নেই। প্রতিদিন এই ধরনের ১০ থেকে ১২ জন রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। একেক জনকে এই সেবা দিতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। এই সেবা নিতে দেড় থেকে দুই মাস অপেক্ষা করতে হয়। বয়স্ক ক্যান্সার রোগীদের রেডিও থেরাপি দিয়েও ক্ষত শুকায় না। এই ইনস্টিটিউটে হাইফার ব্রেরিক অক্সিজেন থেরাপি দিয়ে তাদেরও সুস্থ করা হচ্ছে।
প্রতি বছর দেশে প্রায় ৯ লাখ মানুষ পোড়া যায়। এর ৮০ ভাগই চিকিৎসা সেবা নিতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আসেন। তাদের মধ্যে ৯৯ ভাগেরই প্লাস্টিক সার্জারির প্রয়োজন হয়। তবে এই হাসপাতালে আছে জনবল সংকট। বর্তমানে কর্মরত চিকিৎসক আছেন ১৫০ জন। চিকিত্সকের পদ আছে ৩০০। ১৫০ চিকিত্সকের পদ শূণ্য। বর্তমানে নার্স কর্মরত আছেন ৫০০ জন। পদ আছে ৬৪০ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী মিলে ৩৫৩ জন কর্মরত আছেন হাসপাতালটিতে। নিয়োগবিধি জটিলতার কারণে টেকনিশয়ার পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এই অবস্থা সারাদেশেই। তবে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১০ জন টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিয়েছেন এই ইনস্টিটিউটের কর্তৃপক্ষ। তাদের নিয়োগ দেওয়া না হলে ৬০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সমস্যা সৃষ্টি হতো। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে জটিল সব ধরনের সার্জারির জন্য সব শাখা একসাথে রয়েছে, যার মাধ্যমে সকল চিকিৎসা সেবা ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। বেশী পোড়া রোগীদের সর্বাধুনিক ও সর্বোত্তম মান চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশে এই প্রথম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন স্কিন ব্যাংক সুবিধা চালু আছে, ফলে বেশি পোড়া রোগীদের জীবন রক্ষার যুগান্তকারী অগ্রগতি হচ্ছে। হাইপার ব্রেরিক অক্সিজেন থেরাপি সেন্টারের মাধ্যমে শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়া রোগীদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। শরীরের পোড়া অংশ পরিস্কার করে জীবাণুমুক্ত করার জন্য রয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ট্যাংক সুবিধা।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী। ছবি : আবদুল গণি
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম বলেন, চাহিদার তুলনায় জনবল কম আছে। তারপরও বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই হাসপাতালের সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণেই হাসপাতালটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামান্ত লাল সেন বলেন, ঢাকার বাইরে আরো পাঁচটি বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট করার প্রস্তুতি চলছে। যাতে হাতের কাছেই মানুষ আধুনিক সুচিকিৎসা পাবে। ডাক্তারের পাশাপাশি অন্যান্য অভিজ্ঞ জনবলের প্রয়োজন।
রফিকুল ইসলাম জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। এইচএসসি পাশ করে রাজবাড়ির পাংশায় একটি কলেজে তিনি বিএ ভর্তি হন। তিন বছর বয়সে তার বাবা নজরুল ইসলাম বিশ্বাস মারা যান। মা আলেয়া অনেক কষ্ট করে এইচএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছে। মেট্রিক পাশ করে বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে ৫০ হাজার টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করার শর্তে এনে দোকান দেয় রফিকুল ইসলাম। তার ছিল জন্মগত ত্রুটি। কোমড়ের নিচে ও হাটুর উপরে কালো দাগ ছিল। এটা বড় হতে থাকে। দুই পায়ের উড়~তে বড় আকারের মাংস ঝুলতে থাকে। তার পক্ষে চলাফেরা করা সম্ভব হয় না। একই সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অংশে গুটি গুটি টিউমার দেখা দেয়। গত এক মাস যাবৎ এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। এক দফা অপারেশন সফল হয়েছে। আরো অপারেশন দরকার। এরপর প্লাস্টিক সার্জারি করার পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। বিদেশে এই রোগের চিকিৎসা সেবা করতে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা টাকা খরচ হতো। রফিকুল ইসলাম বলেন, এখানে চিকিৎসা নিতে আমার কোন টাকা খরচ হয়নি। ২০ লাখ টাকা তো দূরের কথা, দুই লাখ টাকার চিকিৎসা ব্যয় বহন করা তার পক্ষে অসম্ভব। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়ে তিনি অনেক খুশি।
জাকির হোসেন নাক কাটা সমস্যা নিয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। চার বছর বয়সে বটিতে তার নাক কেটে যায়। লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের খিদিরপুরের বাসিন্দা জাকির হোসেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে আর তা চালিয়ে যেতে পারেননি। নাক কাটার কারণে সবাই তাকে হাসিঠাট্টা করতো। এক পর্যায়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এই হাসপাতালে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে চিকিত্সকরা জানান। রোগীর স্বজনরা জানান, ওষুধ সামগ্রীর সব হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়।
বান্দরবনের লামার হেবরং মিশর গ্রামের বাসিন্দা জুলি ত্রিপুরার (৪২) ছয় মাস বয়সে মাথায় হারিকেন পড়ে পুড়ে যায়। ওই সময় চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে যায়। তবে কয়েক বছর না যেতেই মাথায় দেখা দেয় ইনফেকশন। পরীক্ষা করে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা অপারেশন করে তার ক্যান্সার ফেলে দিয়েছে। রি-কনস্টেকশনও করা হয়েছে। এখন তার মাথার অবস্থা স্বাভাবিক। বিদেশে এর জন্য খরচ হতো ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু এখানে অপারেশন করতে তার কোন টাকা ব্যয় হয়নি বলে জানান।