ডেস্ক নিউজ
একসময় সামাজিক সূচকে শ্রীলঙ্কা ছিল এ অঞ্চলের সেরা। শিক্ষায় ছিল সবার তুলনায় এগিয়ে। পোশাক খাত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ঢুকেছিল শ্রীলঙ্কাতেই। পর্যটকদেরও পছন্দের জায়গা ছিল ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। কিন্তু গৃহযুদ্ধ শ্রীলঙ্কাকে আর সামনে এগোতে দেয়নি। নিরাপত্তার অভাবে পোশাকশিল্প ’৮০-এর দশকে চলে আসে বাংলাদেশে। কমে যায় পর্যটক। পিছিয়ে পড়ে অর্থনীতি। অনিয়ন্ত্রিত কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ, অভ্যন্তরীণ মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা, মেগা প্রকল্পের দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে দেশটির অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৬১ শতাংশের বেশি, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা নির্দেশ করছে। কারণ কোন দেশের জন্য বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০ শতাংশকে আদর্শ বলে মনে করা হয়। গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশটির অর্থনৈতিক এ সঙ্কট দেখে বাংলাদেশেও কথা উঠেছে, এই দেশের সামনেও এমন আশঙ্কা আছে কি না। যদিও বৈদেশিক ঋণে বাংলাদেশ এখনও ঝুঁকিমুক্ত বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ যেসব বড় বা মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার একটাও অপ্রয়োজনীয় নয়; সবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজন।
পর্যটননির্ভর শ্রীলঙ্কান সরকারের রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটনে ধস নেমেছে করোনার দুই বছরে। পর্যটকদের ভ্রমণ বন্ধ থাকায় কার্যত এ খাত থেকে দেশটির আয় হয়নি। কিন্তু পর্যটক আকৃষ্ট করতে গ্রহণ করা নানা প্রকল্পে আগে নেয়া বিপুল বিদেশী ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছে, রফতানি আয় ও রেমিটেন্সও পৌঁছেছে তলানিতে। পাশাপাশি কর ও ভ্যাট কমানো, কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার শূন্যতে নামিয়ে আনার কারণে উৎপাদনের ঘাটতি, সব মিলিয়ে কিছু ভুল পরিকল্পনা আর পদক্ষেপের কারণে এমন দশায় পৌঁছেছে দেশটি। শ্রীলঙ্কায় সঙ্কট এতটাই ঘনীভূত হয়েছে যে, কাগজ, জ্বালানি তেলসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কুলান নেই। ফলে কাগজ সঙ্কটে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ। জ্বালানি তেল সঙ্কটে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো দৈনিক ১০ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সঙ্কটের মুখে দেশটির মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর গতকাল পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিরও পদত্যাগ দাবি করছে দেশটির জনগণ। গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কায় সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরও নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে আরেকটি শহর তৈরি করা হচ্ছে। এর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২৫ বছর এবং বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। এই শহরটি হংকং, দুবাই ও সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেবে- এমন কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়েছে, কিন্তু বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি। গত এক দশকে চীনের কাছ থেকেই শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়েছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার, যা তাদের মোট ঋণের ১০ শতাংশ। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেছেন, ‘মেগা প্রকল্পের লগ্নি ফেরত না এলে বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কা হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেকগুলো মেগা প্রকল্প হচ্ছে, যেগুলোর প্রয়োজন আছে। কিন্তু এমন অনেকগুলো আছে, যেগুলোর এই মুহূর্তে আসলে কোন উপযোগিতা বা প্রয়োজন নেই। পদ্মা সেতু আমাদের দরকার আছে, যদিও এখানে ব্যয় বেড়েছে অনেক। কিন্তু ওই রুটে পদ্মা রেল সেতুর খুব একটা প্রয়োজন নেই। কারণ পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে ওই এলাকা থেকে সহজেই পণ্য ঢাকায় আসবে, আবার নৌপথ রয়েছে। এখানে রেলপথে যে এক্সট্রা ভ্যালু এডিশন হওয়ার কথা, সে সুযোগ নেই। যে বিশাল বিনিয়োগ হচ্ছে, সেটা ফেরত আসার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘রূপপুর বিদ্যুতকেন্দ্র প্রকল্পে আমাদের ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য আমরা আড়াই বিলিয়ন ডলারের জায়গায় ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছি। এই প্রকল্প হয়তো আমাদের দীর্ঘমেয়াদে কাজে আসবে। কিন্তু আমাদের টাকা তো এখন দরকার। এ টাকা দিয়ে যদি আমরা আমাদের সবগুলো হাইওয়ে ফোর লেন করে ফেলতাম, সড়কগুলো আরও চওড়া করতে পারতাম, তাহলে রেট অব রিটার্ন অনেকগুণ বেশি পেতাম। অর্থনীতিতে আরও দ্রুত উপকার পাওয়া যেত।’
মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘কেউ কেউ সরাসরি শ্রীলঙ্কাকে বাংলাদেশে বসিয়ে রায় দেয়, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ইকোনমিক সাইন্সেও গ্রহণযোগ্য নয়, সামাজিক বিজ্ঞানেও গ্রহণযোগ্য নয়, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থনীতি। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রকল্প ও প্রস্তুতি সে রকম নয়। আমরা শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে কোন মন্তব্য করতে পারি না। তবে এটা নিয়ে গবেষকদের আলোচনা আমরা দেখছি, শুনছি এবং সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছি। তিনি বিষয়গুলোকে নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সকর্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ঋণ ব্যবস্থা, প্রকল্প, কৃষি উৎপাদন, রিজার্ভ, রেমিটেন্স সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার চেয়ে বেশ সফল এবং এগিয়ে। তাই বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোন আশঙ্কাই নেই বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মধ্যে তুলনা চলে না। দুটির গতি-প্রকৃতি ভিন্ন। এখানে উৎপাদনে ঘাটতি নেই। পাশাপাশি রফতানি আয় ও রেমিটেন্সও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। প্রধান খাদ্যপণ্যও আমদানিনির্ভর নয়। আর বাংলাদেশের বিদেশী ঋণও শ্রীলঙ্কার মতো মাথাপিছু এত বেশি নয়। বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোন চাপই তৈরি করছে না। দেশের রিজার্ভও শ্রীলঙ্কার তুলনায় আকাশচুম্বী বলা যায়। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিবেচনায় বাংলাদেশ যেসব বড় বা মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার একটাও অপ্রয়োজনীয় নয়; সবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সঙ্গে সঙ্গে রিটার্ন আসবে। দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থান হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে।’ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘এই সেতুটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী গতি সঞ্চার করেছে, তা এখন আমরা প্রতি মুহূর্তে অনুধাবন করছি। পদ্মা সেতুসহ যেসব প্রকল্প এখন চলমান রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলেও একই ধরনের রিটার্ন পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল এক বিলিয়ন ডলারেরও কম (৯৭ কোটি ডলার)। স্বাধীনতা-উত্তর দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশ তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দাতাদের থেকে অনুদানই পেত বেশি। ফলে সে সময় বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বাড়ত খুবই ধীরগতিতে। এতে ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় চার দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। পরের দশকে যদিও তা বৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে। পরের দশকে তা বৃদ্ধির হার কমে আসে। এতে ২০০০-০১ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলারে। আর ২০১০-১১ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে। তবে গত এক দশকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হার দ্রুত বাড়ায় ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে এর স্থিতি দাঁড়ায় ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক লাফে প্রায় আড়াইগুণ হয়ে গেছে।
যদিও এর পুরোটাই সরকারের নিজস্ব ঋণ নয়। এর মধ্যে সরকারের বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ৫০ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। অবশিষ্ট ঋণের মধ্যে রয়েছে আইএমএফের বাজেট সহায়তা ও সরকারী বিভিন্ন সংস্থার ঋণ। এর মধ্যে বিদ্যুত খাতের জন্য নেয়া হয়েছে পাঁচ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার, আইএমএফের দুই দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার, বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইন্সের উড়োজাহাজ কেনায় এক দশমিক শূন্য চার বিলিয়ন ডলার, বিসিআইসির সার কেনায় শূন্য দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিসির অপরিশোধিত তেল কেনায় শূন্য দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সাত বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছর দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছর বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৩২ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৩৮ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। পরের তিন অর্থবছর তা আরও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৫১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছর ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক ঋণের এ দ্রুত বৃদ্ধি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পথে নিয়ে যাচ্ছে কি না- জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নানা ধরনের অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রথমত, দেশটির সরকার অধিক জনপ্রিয়তা পাওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক হারে কর হ্রাস করেছে। কিন্তু সরকারী ব্যয় নির্বাহের জন্য বিকল্প অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করেনি। এক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে নতুন করে ব্যাপক হারে নোট ছাপানো হয়েছে। এতে করে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এমন কিছু করেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোন ঝুঁকির মধ্যে নেই।’