- তিন মাসে রফতানিতে আয় ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার
- করোনায় সারাবিশ্বে নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে পাটপণ্যের চাহিদা
রহিম শেখ ॥ গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ পাটকলে উৎপাদন বন্ধ করে ২৪ হাজার ৮৮৬ স্থায়ী শ্রমিককে অবসরে পাঠানো হয়েছে। তবে সরকারী পাটকলগুলো বন্ধ হলেও পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রফতানি আয় বেড়েই চলেছে। করোনা মহামারীর মধ্যে গত তিন মাসে রফতানি আয়ে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই খাত থেকেই। এই সময়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় করেছে দেশ। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই মহামারীর বছরেই পাটের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে বলে মনে করছেন তারা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় করেছে দেশ। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এসেছে প্রায় ১২ শতাংশের মতো। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে সঙ্কটে পড়া চামড়া খাতকে (৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) পেছনে ফেলে তৈরি পোশাকের পরের স্থান দখল করে নিয়েছে পাট খাত। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছিল ১০২ কোটি ডলার। আর পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ৮১ কোটি ৬২ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। সে হিসেবে এক বছরে চামড়ার রফতানি যতটা কমেছে, তার তুলনায় পাটের রফতানি বেড়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে গত অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বড় সব খাতের রফতানি আয়ে ধস নামলেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি আয়ে বরাবরই দেখা গেছে উল্টো চিত্র। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ২২ কোটি ৫১ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে এই তিন মাসে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।
জানা গেছে, সোনালি আঁশে সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বপ্নে স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালে বিজেএমসির আওতায় ৭৬টি পাটকল ছিল। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মিলসংখ্যা কমতে কমতে ২৫-এ ঠেকে। গত জুলাই মাসে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এই পাটকলগুলোতে উৎপাদিত চট, বস্তা, থলে বিদেশে রফতানি হতো। বন্ধের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসি। বর্তমানে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও বেসরকারী খাতের অনেক পাটকল ঠিকই মুনাফা করতে পারছে। বন্ধ ঘোষণার কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে, দেশের পাট শিল্পকে আবার কীভাবে প্রতিযোগিতায় আনা যায় এবং কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিবেচনা থেকেই পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়েছে। এর আগে বন্ধের বিষয়ে মত দিয়ে পাটকলগুলো দ্রুত চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বন্ধ হওয়া পাটকল দ্রুত চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে ঢাকার করিম জুট মিলসের ১ হাজার ৭৫৯ শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।’
এদিকে সরকারী পাটকলগুলো বন্ধ হলেও পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রফতানি আয় বেড়েইে চলেছে। করোনা মহামারীর মধ্যে গত তিন মাসে রফতানি আয়ে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই খাত থেকেই। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৯৮৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ হাজার ডলার এসেছে পাট ও পাট পণ্য রফতানি থেকে। এই তিন মাসে পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) রফতানি হয়েছে ২১ কোটি ৮ লাখ ২ হাজার ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৩ শতাংশ। কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে ৪ কোটি ১১ লাখ ৫ হাজার ডলার; আয় বেড়েছে ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৯ হাজার ডলারের। আয় বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পাট ও পাটসুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২ হাজার ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এছাড়া পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রফতানি হয়েছে ২ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ডলার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ মোট ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছিল। ওই অঙ্ক ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছিল ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে পাটসুতা রফতানি থেকে ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। অর্থাৎ মোট রফতানি ৬৪ শতাংশই এসেছিল পাটসুতা রফতানি থেকে। কাঁচাপাট রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ১৩ কোটি ডলার। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। এছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি হয়েছিল ১৯ কোটি ডলারের।
২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১১৬ কোটি ৭০ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলার। তবে মহামারী না থাকলে এই লক্ষ্য গত অর্থবছরেই অর্জিত হতো বলে মনে করেন বাংলাদেশ পাটপণ্য রফতানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থবছরের শেষ তিন মাসে করোনাভাইরাসের ধাক্কা না লাগলে গত অর্থবছরে এ খাতের রফতানি ২৫ শতাংশের মতো বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মতো ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যেত। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রফতানি করে ১০২ কোটি (১.০২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ওই একবারই এ খাতের রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। বিজেজিইএর চেয়ারম্যান বলেন, ‘তিন মাসের যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে রফতানি আয় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমলেও পাটপণ্যের চাহিদা কমবে না। খাদ্যের জন্য ফসল ফলাতেই হবে, আর সেই ফসল মোড়কজাত বা বস্তাবন্দী করতে পাটের থলে লাগবেই।’
এ বিষয়ে বেসরকারী পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া বলেন, এখন শুধু বস্তা, চট ও থলে নয়, পাটসুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটি যদি আমরা নিতে পারি তাহলে আমাদের এ খাতের রফতানি অনেক বাড়বে; এই মহামারীর বছরেই আমরা আমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব।’ কৃষি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের পাটের রফতানি বাজার বরাবরই ভাল ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী বন্ধসহ একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা সেই বাজার ধরতে পারিনি। এখন মহামারীর কারণে পাট ও পাট পণ্য রফতানির যে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেটা আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব সেটাই এখন বড় বিষয়।’
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, বর্তমানে দেশে পাট চাষীর সংখ্যা ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চার কোটি মানুষের জীবিকা পাটকে কেন্দ্র করে। প্রতিবছর মৌসুমে গড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পান কৃষক। দেশের জিডিপিতে পাট খাতের অবদান দশমিক ২৬ শতাংশ ও কৃষি জিডিপিতে তা ১ দশমিক ৪ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাড়ে সাত থেকে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। যেখানে কম বেশি ৮২ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে। গত বছর দেশে ৬৮ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়েছিল দেশে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বেশি পাট উৎপাদন হয় ফরিদপুর, যশোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলায়। তবে সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয় ফরিদপুর জেলায়, সেখানে এবার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে হয়েছিল ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে। পাটনির্ভর এই জেলায় ১৯টি পাটকল আছে; সবই বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে সচল রয়েছে ১৩টি। দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারী খাতের করিম জুট মিল এই ফরিদপুরেই অবস্থিত। ফরিদপুরের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক হযরত আলী বলেন, ৭০ শতাংশ পাট ইতোমধ্যেই কৃষক ঘরে তুলেছেন। যাদের টাকার খুব প্রয়োজন বিক্রি করে দিচ্ছেন। বেশি দামের আশায় মজুদ করে রাখছেন। ফরিদপুরের বিভিন্ন হাটে এবার প্রতিমণ ভাল মানের পাট আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে বলে জানান হযরত আলী। পাবনার চাটমোহর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘হাট-বাজারে ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকায় পাট বিক্রি হচ্ছে। আমি এখনও বিক্রি করিনি; ভাল করে শুকিয়ে ঘরে রেখে দিয়েছি। দাম আরও বাড়লে বিক্রি করব।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উৎপাদিত পাটের ৫০-৫৫ লাখ বেল ব্যবহার হয় বেসরকারী খাতের পাটকলগুলোতে। স্থানীয় বাজার থেকে ফড়িয়া এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা বছরের পাট সংগ্রহ করে বেসরকারী খাতের মিলগুলো। তবে সরকারী পাটকলের মতো বড় গুদাম না থাকায় মৌসুমে প্রয়োজনীয় পাট কেনা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। সরকার চাইলে রফতানি করতে পারে। গত কয়েক বছরে পাট রফতানি বাড়েনি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ বেল কাঁচাপাট রফতানি হতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮-৯ লাখ বেলে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর রফতানি হয় ৮ লাখ বেল। সদ্যসমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরও কমে তা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১৪ হাজার বেলে।