ডেস্ক নিউজ
‘আমাদের পাশের বাড়িতে আগুন লাগছে। গাড়ি পাঠান।’—জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর ‘কল টেকার’ (ফোন যিনি গ্রহণ করেন) পুলিশ কনস্টেবল কৃষ্ণা একটি কল রিসিভ করতেই অন্যপ্রান্ত থেকে নারীকণ্ঠে এভাবেই সাহায্য চাওয়া হয়। ‘লাইনে থাকুন’ বলে মুহূর্তেই কলটি আরেকটি ডেস্কে পাঠান কৃষ্ণা। পাশের ‘ডেসপাচার’ ডেস্কে ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার ফাইটার মেহেদী হাসান সুমন কলটি ধরেই জানতে চান, ‘আপনি কোথা থেকে বলছেন?’ উত্তর শোনার মধ্যেই কম্পিউটারে জায়গার নাম লিখে ফেলেন সুমন। প্রযুক্তির মাধ্যমে সেবাপ্রার্থীর ফোন নম্বরও ভেসে ওঠে কম্পিউটারের পর্দায়। তাঁকে ফোনে রেখেই সুমন কল দেন রংপুর ফায়ার স্টেশনে—‘স্যার, ৯৯৯ থেকে বলছি। টেক্সটাইল মোড়ের পাশের গলির একটি বাড়িতে আগুন লেগেছে। পাশের বাড়ির একজন কল করে জানালেন। তাঁর নাম্বার ০১৭…।’ নিজস্ব কল রেখেই সেবাপ্রার্থীর কলে সুমন বলেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসছে ম্যাডাম।’
এভাবেই মাত্র ২৬ সেকেন্ডে একটি অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে সাহায্যপ্রার্থীকে সেবাদাতার (রংপুর ফায়ার স্টেশন) সঙ্গে যুক্ত করতে দেখা গেল জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ১৪ মিনিটের ওই কলটির পরও রংপুর ফায়ার স্টেশনে ফোন করে খবর নিতেও দেখা গেল দমকলকর্মী সুমনকে। বিকেলে কালের কণ্ঠ থেকে মোবাইল ফোনে কল করা হলে অন্যপ্রান্ত থেকে গৃহবধূ বানু রানী পরিচয়ে সেই সাহায্যপ্রার্থী বলেন, ‘৯৯৯-এ তিনি কল করার দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে যায়। এরই মধ্যে ঘটনাস্থল নিশ্চিত হতে তাঁকে রংপুর স্টেশন থেকে ফোনও করা হয়েছিল। স্থানীয়দের সহায়তায় দ্রুততম সময়ে আগুনও নেভানো হয়েছে।’
সরেজমিনে রাজধানীর আবদুল গনি রোডে পুলিশের ক্রাইম কন্ট্রোল অ্যান্ড কমান্ড সেন্টারে জাতীয় জরুরি সেবাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, এক মিনিটের মধ্যেই জরুরি সেবাপ্রার্থীদের ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও অ্যাম্বুল্যান্সের সেবাদাতাদের সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছেন কর্মীরা। আর এই সেবাদান প্রক্রিয়াও মনিটর করা হচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুল্যান্স গাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে ভুক্তভোগীর কাছে।
সেবা প্রদান বোর্ডে দেখা গেল, যে পরিমাণ কল আসছে তার প্রায় ৩০ শতাংশ ‘কল ফর সার্ভিস’ বা সেবার জন্য উপযুক্ত বিবেচনায় কাজ করা হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২৫ হাজার কল আসছে এই কেন্দ্রে। একসঙ্গে ৮০টি ফোন ধরছেন কল টেকাররা। তবে এখনো প্রচুর পরিমাণ অবাঞ্ছিত কল আসছে, যা কর্মীদের সময় নষ্ট করছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি ও বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পেতেও কিছু সময় দেরি হচ্ছে।
কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর চালুর পর থেকে ক্রমেই জনগণের আস্থায় আসছে পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ পুলিশের তিনটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম ৯৯৯। এখনো আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতার জায়গা থাকলেও সেবা শতভাগ দেওয়া হচ্ছে। কিছু অবাঞ্ছিত কল আসে। এসব অবাঞ্ছিত কলে কর্মীদের কাজের গতি কমে যায়। তবে দেশের সাধারণ মানুষ ৯৯৯-এর সেবা পেতে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, চালুর পর থেকে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক কোটি ৭২ লাখ ৪৪ হাজার ২৮৩টি কল এসেছে ৯৯৯-এ। এর মধ্যে সেবা দেওয়ার মতো সিএসএফ (কল ফর সার্ভিস) ছিল ৩৫ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬৩টি। বাকি এক কোটি ৩৬ লাখ ৯৬ হাজার ৬২০ কলই ছিল অপ্রয়োজনীয়। অনেক কলই আসে কৌতূহলে। এর মধ্যে ‘ক্রাইং’ কল ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯২টি। এসব কলে কল টেকারদের উত্ত্যক্ত করাসহ অবাঞ্ছিত আলাপও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কলে নারী কর্মীদের মেজাজ খারাপসহ কাজে মনোযোগ নষ্ট হয়। এতে সেবা প্রদানও বিঘ্নিত হচ্ছে।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সেবার জন্য বিবেচিত ৩৫ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬৩টি কলের মধ্যে ২৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৬টি কলের ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিস, রোগী পরিবহনে অ্যাম্বুল্যান্স ও বিপদে পুলিশি সেবা দেওয়া হয়েছে। বাকি ১২ লাখ ২১ হাজার ৫৮৭টি কলকে অজরুরি বা ইনকোয়ারি কল (অনুসন্ধান) বলা হচ্ছে। এসব কলে ৯৯৯-এর কর্মীরা সেবার ব্যবস্থা না করতে পারলেও ফোনে বিভিন্ন সেবার ব্যাপারে তথ্য দিয়ে মানুষকে সহায়তা করেছেন।
৯৯৯ থেকে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এক লাখ ৭১ হাজার ৪৭ জন থানা পুলিশের সেবা, ৩৩ হাজার ১৯৭ জন অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের সেবা এবং ২৭ হাজার ৫৩১ জন অসুস্থ রোগীকে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স পেয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে পুলিশের ক্রাইম কন্ট্রোল অ্যান্ড কমান্ড সেন্টার ভবনে দেখা গেছে, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় ১০০টি ডেস্ক বসিয়ে ৯৯৯ সেবা চালানো হচ্ছে। পঞ্চম তলায় পুরুষ ও ষষ্ঠ তলায় বসছেন নারী কল টেকাররা। প্রতি ঘণ্টায় এক হাজারেরও বেশি কল চলে আসছে এই কেন্দ্রে। পঞ্চম তলায় দুপুর ১টা ৩৭ মিনিটের ডেসবোর্ডে (তথ্য-সংবলিত মনিটর) দেখা যায়, আট হাজার ৬৮ কল এসেছে। এর মধ্যে ২৯৭টি কলে সেবা প্রক্রিয়াধীন এবং ২৩২টি কলে সেবা দেওয়া হয়েছে। তখন কল চলছিল ৬১টি। সেবার মান পর্যবেক্ষণে থাকা পুলিশ পরিদর্শক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘কল ধরেই কল টেকার বুঝে ফেলেন কী সেবা লাগবে। তিনি তখন আরেকটি ডেসপাচারের কাছে দিয়ে দেন। সেখানে কেস সলভ না হওয়া পর্যন্ত মনিটরিং চলে। আমরা চারজন আছি যারা এই মনিটরিং তত্ত্বাবধায়ন করি।’
কলে সেবা প্রদান দেখার ফাঁকে দুপুর ২টা ৭ মিনিটে দেখা গেল, ডেসবোর্ডে কলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৭২৭-এ। ৩০০ জন সেবা পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন। ততক্ষণে সেবা দেওয়া হয়ে গেছে ২৫২ জনকে। আর ৩৮ জন কলে ছিলেন তখনো।
অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ জানান, ৯৯৯-এ এখন মোট লোকবল আছে ৩৭৬ জন। তাঁদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ১০ জন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১০ জন প্রতিনিধি আছেন। আট ঘণ্টার প্রতি শিফটে ৮০ জন ‘কল টেকার’ (কনস্টেবল থেকে এএসআই) কল গ্রহণ করেন। ১৬ জন ডেসপাচার (পুলিশের এসআই, ফায়ার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি) থানা, ফায়ার স্টেশন ও অ্যাম্বুল্যান্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেবা নিশ্চিত করেন। প্রতি শিফটে চারজন সুপারভাইজার (পুলিশ পরিদর্শক) তত্ত্বাবধায়ন করেন। তাঁদের ওপরে চারজন কোয়ালিটি অ্যাশিউরেন্স অফিসার (পরিদর্শক) এবং তাঁদের নেতৃত্বে একজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আছেন।