ডেস্ক নিউজ
মহামারি করোনার ভয়ঙ্কর থাবা পড়েছিল আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতেও। এক পর্যায়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন কঙ্গোতে (মনুস্কো) কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেখানে সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে করোনা মোকাবিলা করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন কার্যক্রম সচল করেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা।
গত ৪ জুলাই সরেজমিন কঙ্গোর উত্তর প্রদেশের পাহাড়বেষ্টিত সাকে এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীদের কোয়ারেন্টাইন কার্যক্রম। প্রায় ১০ হাজার মাইল দূরের এই গোলযোগপূর্ণ দেশে শান্তি স্থাপনের পাশাপাশি করোনা মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। বিশেষত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যেসব দেশের শান্তিরক্ষীরা কঙ্গোতে আসেন তাদের প্রত্যেককে এখানেই বাধ্যতামুলক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হচ্ছে।
কঙ্গোর গোমায় অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কন্টিনজেন্টের (ব্যান ইঞ্জিনিয়ার-১১) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুবুল হক সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমানে কঙ্গোর গোমা শহরের পাশেই সাকে এলাকায় ব্যান ইঞ্জিনিয়ার কন্টিনজেন্টের শান্তিরক্ষীদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে তিনটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। যেখানে বর্তমানে কঙ্গোতে কন্টিনজেন্ট প্রতিস্থাপন করতে আসা বাংলাদেশি ১৯৩ জন শান্তিরক্ষীসহ মরক্কোর ২৪৫ জন ও কেনিয়ার ৩০ জন কোয়ারেন্টাইনে আছেন। ব্যান ইঞ্জিনিয়ারিং কন্টিনজেন্ট এসব কোয়ারেন্টাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সার্বিক দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের নিয়ম-শৃঙ্খলার বিষয়টি দেখভাল করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশ (ব্যান এমপি) ইউনিট। কর্নেল মাহবুব আরও বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এই কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব না নিলে এতদিনেও হয়তো কঙ্গোতে শান্তিরক্ষা মিশন কার্যক্রম বন্ধই থাকত।
সরেজমিন দেখা গেছে, সাকে এলাকায় কালো মাটি ও পাথরের ধুধু প্রান্তরে বিশাল লেকের পাড়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের কন্টিনজেন্ট ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পের পাশেই দীর্ঘ এলাকাজুড়ে তাঁবু টানিয়ে তৈরি করা হয়েছে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। ক্যাম্প সংলগ্ন লেকের অন্যপ্রান্তেই সুউচ্চ পাহাড়বেষ্টিত এলাকা। সেখানে সার্বিকভাবে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার দেখাশোনা করছিলেন একমাত্র বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা।
গোমার সাকেতে নিয়োজিত ব্যান ইঞ্জিনিয়ারিং কন্টিনজেন্টের অপারেশন অফিসার মেজর শাফিউল মোজনেবীন সময়ের আলোকে বলেন, মাত্র এক মাসের প্রচেষ্টায় একই সময়ে ৭৫০ জনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই এসব কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে সর্বমোট ১ হাজার ১৯২ জন শান্তিরক্ষী কোয়ারেন্টাইন সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে কেবল একজনের করোনা পজিটিভ হয়েছিল। পাশাপাশি গোমা শহরের পাশে ব্যান ইঞ্জিনিয়ারিং কন্টিনজেন্টের তত্ত্বাবধানে আরও ৬০০ জনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টার চালুর প্রক্রিয়া চলছে।
মেজর শাফিউল আরও বলেন, করোনার ভয়ঙ্কর সংক্রমণ বা মৃত্যুঝুঁকি জানা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা এ কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে যথাযথভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য ইতোমধ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রশংসাও অর্জন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কন্টিনজেন্ট।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশ ইউনিটের (ব্যান এমপি-১৬) সাকে ডিটাচমেন্ট কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার ইফতেখারুল বাশার সময়ের আলোকে বলেন, সাকেতে বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষীদের ক্যাম্প থাকলেও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে ব্যান এমপি কন্টিনজেন্ট। স্বাস্থ্যঝুঁকি বা করোনাভীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এ কাজটি সচল রেখেছেন বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বরাবরই এক গৌরবের নাম। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীদের দক্ষতা, সাহসিকতা ও মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক আস্থার নাম। সেটি আবারও এই মহামারি করোনাকালেও দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। কেননা এই কোয়ারেন্টাইন সেন্টার চালুর মাধ্যমে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে কঙ্গোতে শান্তিরক্ষা মিশন কার্যত বন্ধ হয়ে থাকত বলে মনে করেন এখানকার স্থানীয় জনগণ ও অন্যান্য দেশের শান্তিরক্ষীরাও।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মিশনে ‘লেঙ্গুয়েজ অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসেবে গোমায় নিয়োজিত ব্যাঙ্গো জন সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমার বাড়ি কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসায়। কয়েক বছর ধরে আমি গোমায় কর্মরত থেকে বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষীদের নানা কার্যক্রম দেখছি। এর মধ্যে স্পষ্ট করে বলতে পারি, বাংলাদেশ আর্মি এখানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করছে। সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, তারা (বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা) সাধারণ মানুষের আস্থার ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে আছে। কি অন্য দেশের শান্তরক্ষী আর কিংবা স্থানীয় জনগণ, যে কেউ যেকোনো ধরনের সহায়তা চাইলেই বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের সাহায্য করে থাকেন। শৃঙ্খলা ও দক্ষতার দিক থেকেও তারা সেরা বলে মন্তব্য করেন তিনি।