জ্বালানি কেন্দ্র, অর্থনৈতিক জোন, শিল্পায়ন, গভীর সমুদ্র বন্দরসহ একগুচ্ছ মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নকে ঘিরে বদলে যাচ্ছে মহেশখালী পাহাড়ি দ্বীপ। দেশের বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নপূরণের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি ভেনাস ট্রায়াম্প’ প্রথম ভিড়লো অনায়াসে। মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি নিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে আসে জাহাজটি।
মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মিত ও নির্ধারিত জেটিতে নোঙর ফেলে ভেনাস ট্রায়াম্প। অবশ্য ইতোপূর্বে মাতারবাড়ীতে প্রকল্পের কাজে অন্য জাহাজও আসে। গতকাল ভেনাস ট্রায়াম্প ভিড়ার মধ্যদিয়ে মাতারবাড়ী বাংলাদেশের শুধুই নয়; দক্ষিণ এশিয়ায় এবং পোর্ট-শিপিং মানচিত্রে ও ইতিহাসের অংশ হিসেবে তার প্রাথমিক পথচলা শুরু করলো। যা এ প্রকল্পে একটি মাইলফলক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বহুমুখী সুবিধা সম্পন্ন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে।
এদিকে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন তদারককারী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, মাতারবাড়ীতে আরও চমক অপেক্ষা করছে। শিগগিরই সেখানে চ্যানেল দিয়ে নোঙর ফেলবে ১৬ মিটার ড্রাফটের বৃহৎ জাহাজ। তাছাড়া জোয়ার-ভাটার নির্ভরতা ছাড়াই গভীর চ্যানেলে জাহাজ আসা-যাওয়া ও বার্থিং করতে (ভিড়তে) সক্ষম হবে।
পানামার জাহাজ ‘এমভি ভেনাস ট্রায়াম্প’ ভিড়ার জন্য গতকাল জোয়ার-ভাটার সময়ের জন্য বঙ্গোপসাগরে বহির্নোঙরে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। বহিনোঙর থেকে সরাসরি অনায়াসে এবং সফলভাবে চ্যানেল অতিক্রম করে মাতারবাড়ী নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্র বন্দরের জেটিতে ভিড়েছে জাহাজটি। তখন দেশি-বিদেশি নির্মাণ প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, শ্রমিক ও স্থানীয় জনসাধারণ আনন্দ প্রকাশ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমভি ভেনাস ট্রায়াম্প জাহাজযোগে ৩১৩ প্যাকেজে ৭৩৬ মেট্রিক টন স্টিলের নির্মাণ সামগ্রী, স্ট্রাকচার, যান্ত্রিক সরঞ্জাম আনা হয়েছে। সেগুলো খালাসের প্রক্রিয়া চলছে। ৪ দশমিক ৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার। জাহাজবাহী এসব সরঞ্জাম মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক আলট্রাসুপার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হবে। এর মধ্যে রয়েছে বীম, কলাম, গার্ডার, টাওয়ার ইত্যাদি। জাহাজটির লোকাল এজেন্ট অ্যানসাইন্ট স্টিমশিপ কোম্পানি লি.।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের তদারকিতে মাতারবাড়ীতে জাহাজটি ভিড়ানো হয়। পানামীয় েেভনাস ট্রায়াম্প জাহাজটিকে চট্টগ্রাম বন্দরের চৌকস দু’জন সিনিয়র পাইলটের নেতৃত্বে সতর্কতার সাথে বন্দরের টাগবোট ‘কান্ডারী-৮’ এর সহায়তায় জেটিতে ভিড়ানো হয়। এর আগে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে জাহাজটি ইন্দোনেশিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এসে পৌঁছায়। মাতারবাড়ী নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেলের ড্রাফট বেশি থাকায় জোয়ারের জন্য বহির্নোঙরে জাহাজকে তেমন অপেক্ষা করতে হয়নি। সরাসরি জেটিতে ভিড়তে সক্ষম হয়।
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) গবেষণার মাধ্যমেই মাতারবাড়ী বহুমুখী সুবিধা সম্পন্ন গভীর সমুদ্র বন্দরের সম্ভাবনা উদঘাদিত হয়েছে। জাইকার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নির্মাণ কাজ চলছে। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজও করছে জাপানি সংস্থা। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য বঙ্গোপসাগেরে এখন পর্যন্ত যে চ্যানেলটি সৃজন বা উন্নয়ন করা হয়েছে সেটি ২৫০ মিটার চওড়া এবং ১৮ মিটার গভীরতা সম্পন্ন। এরফলে সেখানে অন্তত ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের তলদেশের গভীরতার মাপ) জাহাজ ভিড়তে সক্ষম হবে। জাহাজ চলাচলে নির্দেশনার জন্য চ্যানেলে ৬টি বয়া স্থাপন করা হয়েছে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনে ব্যয় হবে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাইকার ঋণ সহায়তা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছে ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। বিগত ১০ মার্চ একনেক কর্তৃক মেগা প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে নির্মিত হচ্ছে বহুমুখী সুবিধা সম্পন্ন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল গ্রোথ (বিগ-বি)’ উদ্যোগের আওতায় মহেশখালী, কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পায়ন-বিনিয়োগ এবং অবাকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর মাতারবাড়ী মেগাপ্রকল্প নির্মাণ কাজে জাপানের নিপ্পন কোই নামক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। পরামর্শকের ব্যয় ২৩৪ কোটি টাকা। এরআগেই জাপানের ব্যয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আর্থিক ও কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করা হয়। এই মেগাপ্রকল্পে নিপ্পন কোই’র নেতৃত্বে জাপানের আরও দু’টি এবং দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সেগুলো হচ্ছে জাপান পোর্ট কনসালটেন্ট, সিডিআই ও ডিডিসি। তাদের মাধ্যমে নকশা প্রণয়ন, সুপারভিশন, মনিটরিং, টেন্ডার সহায়তাসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।
পূর্ণাঙ্গ নকশা জমাদানের পর ২০২১ সালে ঠিকাদার নিয়োগ হবে। ২০২৬ সালে পুরোদমে নির্মাণকাজ শেষে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর অপারেশনে যাবে। তবে ২০২৫ সালে টার্মিনালের কার্যক্রম শুরুর টার্গেট রয়েছে। তাছাড়া বন্দর নির্মাণের ধাপে ধাপে জাহাজ ভিড়বে সক্ষমতা, অবকাঠামো সুবিধা ও চাহিদা অনুযায়ী।
মাতারবাড়ী নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর জাপানের কাছে গুরুত্বের শীর্ষে। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি সম্প্রতি চিটাগাং চেম্বারের অনুষ্ঠানে উচ্চাশা ব্যক্ত করেছেন, মাতারবাড়ী হবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গেম চেঞ্জার অর্থাৎ যুগান্তকারী।