ডেস্ক নিউজ
সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এরই মধ্যে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের তৈরি খসড়া আইনের ওপর মতামত চেয়েছে অর্থ বিভাগ। এ বিষয়ে যে কেউ আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে মতামত দিতে পারবেন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গেও মতবিনিময় শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সবার মতামত নেওয়ার পরই চ‚ড়ান্ত করা হবে বহুল প্রত্যাশিত আইনটি।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ চালু হলে ১৮ বছর বয়স থেকে যদি কেউ চাঁদা দেওয়া শুরু করেন এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু থাকে, তা হলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর মাসে পেনশন পাবেন ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা। আর এটি ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি পেতে থাকবেন। আর যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা দেওয়া শুরু করে ৬০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন, তা হলে অবসরের পর প্রতি মাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন তিনি।
সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে এটি প্রবর্তনের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। সম্প্রতি কৌশলপত্রটি প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করার পর তিনি কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করেই সর্বজনীন পেনশন আইনের খসড়া তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেওয়ার পর একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা পাওয়া যাবে।
জানা গেছে, অর্থমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে ১৫ সদস্যের গভর্নিং বোর্ডের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে। গভর্নিং বডির সদস্যরা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক সচিব, অর্থ বিভাগের সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চেয়ারম্যান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন সভাপতি, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন সভাপতি এবং বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (বিডব্লিউসিসিআই) নির্বাহী চেয়ারম্যান, যিনি এর সদস্য সচিবের দায়িত্বে থাকবেন।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে। এটি চালু করার লক্ষ্যে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের তৈরি আইনের খসড়ার ওপর সংশ্লিষ্টদের মতামত চাওয়া হবে। সবার মতামত নিয়েই চ‚ড়ান্ত করা হবে এটি।’
খসড়া আইনে যা বলা হয়েছে- জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতায় ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক এতে অংশ নিতে পারবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন এ কর্মসূচিতে। অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতাবহিভর্‚ত থাকবে। সরকারি গেজেটে বাধ্যতামূলক করে প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত, প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি স্বেচ্ছাধীন থাকবে। অন্তর্ভুক্তির পর একজন চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়া সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। সেই ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভ‚ত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেওয়া হবে। প্রতিটি চাঁদাদাতার জন্য একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র পেনশন হিসাব থাকবে, যা এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধির মাধ্যমে পরিচালিত হবে। চাকরিরত চাঁদাদাতারা চাকরি পরিবর্তন করলেও পূর্ববর্তী হিসাব নতুন কর্মস্থলের বিপরীতে স্থানান্তরিত হবে, নতুনভাবে হিসাব খোলার প্রয়োজন হবে না। কর্তৃপক্ষ মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারণ করবে। মাসিক এবং ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দিতে পারবে এবং অগ্রিম ও কিস্তিতে জমা দেওয়ার সুযোগ থাকবে। মাসিক চাঁদা দিতে দেরি হলে, বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে পেনশন হিসাব সচল রাখা যাবে এবং ওই বিলম্ব ফি চাঁদাদাতার নিজ হিসাবে জমা হবে। পেনশন পাওয়া ব্যক্তি আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। আবার পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পূর্বে চাঁদাদাতা মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
পেনশন তহবিলে জমাকৃত অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের প্রয়োজন হলে, চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নেওয়া যাবে। আর সেই অর্থ ধার্যকৃত ফিসহ পরিশোধ করতে হবে এবং ফিসহ পরিশোধিত অর্থ চাঁদাদাতার নিজ হিসাবেই জমা হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে। সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি অথবা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। সময় সময় সরকারের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া সাপেক্ষে, নিম্নআয়সীমার নিচের নাগরিকের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে।
জানা গেছে, বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ। দেশের মানুষের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর, যা ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় আগামী তিন দশকে একজন কর্মজীবীর অবসর গ্রহণের পরও গড়ে ২০ বছর আয়ু থাকবে। বাংলাদেশে বর্তমানে নির্ভরশীলতার হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ শতাংশে এবং ২০৭৫ সালে ৪৮ শতাংশে উন্নীত হবে। গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীল হার বিবেচনায় বৃদ্ধ বয়সের নিরাপত্তা হিসেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা খুবই জরুরি।
অনেকে অবশ্য বলছেন, টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রায় শেষ প্রান্তে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। আগামী ২০২৪ সালের আগেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে ক্ষমতাসীন দলটি। জনসাধারণকে আগামী নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে রাখার কৌশল হিসেবেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে ২০০৯ সালের পরিকল্পনা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এখন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তবে সরকারের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘এটি ইতিবাচক। তবে সাধারণ মানুষ কীভাবে সেটি গ্রহণ করে, তাদের গ্রহণ করার মতো সক্ষমতা আছে কিনা- সেটি পুরোপুরি দেখার পর বিস্তারিত মন্তব্য করা যাবে।’