ডেস্ক নিউজ
‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে, বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা, তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না, না না না, শোধ হবে না।’
১. আমাদের সেনাবাহিনী তথা দেশের গর্ব ও গৌরব ক্যাপ্টেন হায়দার। একজন ক্যাপ্টেন র্যাঙ্কের অফিসারও স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য সাধারণ ইতিহাস সৃষ্টি করে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। হায়দার নামের অর্থ হলো ‘সিংহ’। হ্যাঁ, সিংহের মতোই তেজস্বী ও নির্ভীক বীরযোদ্ধা ছিলেন। নামের অর্থের পরিপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক; ভয়ঙ্কর ও তেজস্বী সিংহের মতো জমদূত। তার নাম শুনে হৃদয় প্রকম্পিত হতো হানাদার বাহিনীর। ৩৫ হাজারেরও বেশি ছাত্র-যুবক ও তরুণকে প্রশিক্ষিত করে গেরিলাযোদ্ধায় পরিণত করেছিলেন তিনি। বৃহত্তর ঢাকা শত্রুমুক্ত হয় তার পরিচালিত বাহিনীর দ্বারা।
২. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যন্ত দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, নির্ভীক, অকুতোভয়, সর্বোচ্চ পেশাগত মানের চৌকস কমান্ডো সেনাদল ‘দ্য স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ’ (এসএসজি) এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া, সামান্য কথা নয়! তাও আবার বাঙালি অফিসারের জন্য, যাদের সাথে পাকিস্তানিরা বিমাতাসুলভ আচরণে অভ্যস্ত। এ সেনাদলে সুযোগ পাওয়ার জন্য খুব কঠিন বেশ কিছু পরীক্ষায় অবতীর্র্ণ হওয়ার পর সূক্ষ্ম যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হয়। এ কঠিন বাধাবিঘœ অতিক্রম করে এসএসজিতে নির্বাচিত হন সেনাবাহিনীর চৌকস, মেধাবী ও দুর্দান্ত এক বাঙালি অফিসার। নাম তার ক্যাপ্টেন আবু তাহের মুহাম্মদ হায়দার। সংক্ষেপে ‘এ টি এম হায়দার’।
৩. বিশ্বজগতের মালিক, পরিকল্পনাকারী সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার পরিকল্পনাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য একজন দুঃসাহসী কমান্ডো অফিসারের। আর সে কারণেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন এ টি এম হায়দারকে এসএসজি প্রশিক্ষণের জন্য। এ অকুতোভয় সেনা অফিসারই সৃষ্টি করেছিলেন এক অসাধারণ ইতিহাস, অজেয়কে করেছিলেন জয় এবং রেখেছিলেন অসামান্য অবদান মাতৃভূমিকে একটি লাল-সবুজ পতাকা দেয়ার জন্য।
৪. ২নং সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের সৌভাগ্য যে, তিনি তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পেয়েছিলেন হায়দারকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কিংবদন্তি হয়ে আছেন এ ক্ষণজন্মা অফিসার। ইতিহাসে এ টি এম হায়দার বীর উত্তম এক অবিস্মরণীয় নাম। খালেদ মোশাররফ মুক্তিযুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পর তিনি ২ নম্বর সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হিসেবেও (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
৫. ১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন এ টি এম হায়দার। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কান্দাইল। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল ব্রিটিশ-ভারত ও পাকিস্তান পুলিশ বিভাগের অত্যন্ত সৎ ও আদর্শবান পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। সে কারণে তাকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। মা হাকিমুন নেসা ছিলেন গৃহিণী। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হায়দার দ্বিতীয়। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন পাবনা জেলার বীণাপানি স্কুলে। ১৯৫৮ সালে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৩ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। পরে লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কোর্সে পরিসংখ্যানে ভর্তি হন। হায়দারের দৈহিক গঠন ছিল অত্যন্ত সুঠাম ও শক্তিশালী। তিনি সুদক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে একনামে পরিচিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সুইমিংয়ে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন।
৬. মাস্টার্স শেষ করে তিনি সেনাবাহিনীতে চতুর্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি ওয়ার কোর্সে যোগদানের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতকার্য হন এবং ১৯৬৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, মিলিটারি একাডেমি কাকুলে যোগ দেন। ছয় মাস প্রশিক্ষণ শেষে একই বছরের ৬ আগস্ট সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে গোলন্দাজ বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন । বদলি হন মুলতান সাঁজোয়া ডিভিশনের সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ইউনিটে। এ ডিভিশনটি পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী স্ট্রাইকিং বা পাঞ্চিং ডিভিশন হিসেবে পরিচিত যা আমেরিকার সেনাবাহিনীর অনুকরণে গড়ে তোলা।
৭. ইউনিটে হায়দারের দক্ষতা, সাহস, জ্ঞান, কর্মস্পৃহা ও আনুগত্যবোধ ইত্যাদি গুণের জন্য অধিনায়ক ও অন্যান্য সিনিয়র অফিসার ছিলেন তার ওপর দারুণ সন্তুষ্ট। ফলে তিনি যথাসময়ে ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন। কর্মদক্ষতার কারণে হায়দারকে ‘দ্য স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে’র প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়। সুকঠিন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৯ সালে তিনি চেরাটে ঝঝএ ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেন ও কৃতিত্বের সাথে সবচেয়ে কঠিন গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষ করেন। উল্লেখ্য, ৩৬০ জন কমান্ডোর মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র দুইজন। কৃতিত্ব ও দক্ষতার সাথে বিশেষ কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তাকে দু’টি পদে বদলির প্রস্তাব দেয়া হয়Ñ ১. চেরাটে কমান্ডো প্রশিক্ষক; ২. কুমিল্লøা তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগদান। তিনি মাতৃভূমির টানে কুমিল্লøা সেনানিবাসে বদলি হওয়াটাই বেছে নিলেন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে হায়দারকে কুমিল্লা সেনানিবাসে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয় এবং তিনি ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে এতে যোগদান করেন। এটা ছিল মহান আল্লøাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশেষ পরিকল্পনার অংশ। কেননা, আল্লাহ ছাড়া কেউ তখন জানত না যে, মাত্র এক বছর পরই হায়দারের মতো বিশেষ প্রশিক্ষিত কমান্ডোর প্রয়োজন হবে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে একটি দেশ গঠনের লক্ষ্যে। আরো উল্লেখ্য, একই সময়ে তার ছোট বোন লেফটেন্যান্ট ডাক্তার সিতারা বেগমও আর্মি মেডিক্যাল কোরে কুমিল্লা সেনানিবাসে চাকরিরত ছিলেন।
৮. ক্যাপ্টেন হায়দারের মতো কমান্ডোকে মুক্ত রাখা বিপজ্জনক হতে পারে ভেবে মার্চ মাসের শুরুর দিকে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠিয়ে তাঁবুর মধ্যে কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সাথে তাকেও অন্তরীণ রাখা হয়। তিনি বাঙালিদের প্রতি এহেন আচরণে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এক সিনিয়র অফিসারের কাছে বেতনের জন্য বললে ৭১ সালের ২১-২২ মার্চ তাকে কুমিল্লøা সেনানিবাসে তার নিজস্ব ইউনিট তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে পাঠানো হয়। ইউনিটে ফিরে এসে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তায় তার সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি বুঝতে পারেন, তারা ভয়ঙ্কর কিছু একটা করার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে এবং বাঙালিদের যেকোনো মুহূর্তে হত্যা করা হতে পারে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় এটা টের পেয়েই তিনি অফিসার্স মেসে রুমে এসে তার পিস্তলটি নিয়ে বাথরুমের জানালা ভেঙে বের হন। অন্ধকারে ক্রলিং করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সেনানিবাসের বাইরে চলে আসেন। তার কমান্ডো ট্রেনিং এ ক্ষেত্রে খুব কাজে লেগেছিল। সে দিন পালাতে এক-দুই মিনিট বিলম্ব করলেই তার ললাটে শহীদ হওয়া ছিল নিশ্চিত। ইতোমধ্যে হানাদাররা বাঙালিদের গ্রেফতার শুরু করেছে এবং মেসে ঢুকেই ‘হায়দার কিধার’, ‘হায়দার কিধার’ বলে চিৎকার করতে থাকে। এখানে উল্লেøখ্য, কুমিল্লøা সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন হায়দার, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানসহ গুটিকয়েক বাঙালি পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর বাকি সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
৯. কুমিল্লøা সেনানিবাস থেকে হানাদারদের কবল থেকে পালিয়ে এসে ক্রমাগত হাঁটতে শুরু করলেন ক্যাপ্টেন হায়দার। একটি মাত্র পিস্তল তার সঙ্গী। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান সম্পর্কে। দীর্ঘ ৬০ মাইল হেঁটে পৌঁছে গেলেন সেখানে। দেখা হলো, তদানীন্তন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের সাথে। তিনি হায়দারকে পাঠিয়ে দিলেন ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সদর দফতর, হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে। এসএসজি প্রশিক্ষিত ক্যাপ্টেন হায়দারকে পেয়ে ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন খালেদ। রতনে রতন চিনে ফেললেন। এ রকমই একজন সুপ্রশিক্ষিত হায়দারের প্রয়োজন ছিল তার। ক্যাপ্টেন হায়দার হাজার হাজার তরুণ, ছাত্র-যুবককে কমান্ডো প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। মেজর খালেদ মোশাররফ সাথে সাথে তার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।
১০. সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুতই শুরু হলো হায়দারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য প্রশিক্ষিত জেসিও/এনসিও এবং সেনাদের নিয়ে তিনি শক্তিশালী একটি প্রশিক্ষণ টিম গড়ে তুললেন। হাজার হাজার ছাত্র-যুবককে কমান্ডো প্রশিক্ষিণ দেয়া শুরু করলেন; যাদের পোশাক ছিল লুঙ্গি, কারো প্যান্ট, কারো পায়জামা, কারো মালকোঁচা মারা লুঙ্গি; গায়ে ময়লা শার্ট, গেঞ্জি। এভাবে বিশাল এক অনিয়মিত বাহিনীর গড়ে তুলতে থাকলেন হায়দার। পাকিস্তানের প্রাপ্ত বিশেষ কমান্ডো প্রশিক্ষণের পুরো অভিজ্ঞতাই কাজে লাগালেন। তিনি আরো জানতেন পাকিস্তানি বাহিনীর দুর্বলতাগুলো। প্রশিক্ষণের সময় তিনি কমান্ডোদের সেগুলোও জানাতেন। হায়দারের ভাষায়, ‘পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনীর মিঠঠা খানের থার্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়নে কাজ করে আমি পাকিস্তানি বাহিনীর সবার চরিত্র সম্পর্কে জেনেছি। কী কী করলে তাদের ঘায়েল করা যাবে, তা-ও আমি জানি। গেরিলাযুদ্ধে সঠিক ও কঠিন প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।’ বোমা, গোলাবারুদ ব্যবহার, স্থাপনা ধ্বংস, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা, রেকি, রেইড, অ্যামবুশ, ডিফেন্স, অ্যাটাক, দ্রুত হামলা ও শত্রু ধ্বংস করে পালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রশিক্ষণগুলো তিনি দিতে থাকলেন। প্রশিক্ষণ শেষ করে বলতেন, ‘তোমরা খুব বুঝেশুনে এগোবে। তোমাদের যে ট্রেনিং ও ব্রিফিং দিয়েছি, তা যদি ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারো জয় আমাদের হবেই, ইনশা আল্লøাহ।’
১১. হায়দার গেরিলাদের শপথ পাঠ করাতেন : ‘আমি আল্লøাহকে সাক্ষী রাখিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার নিজের জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত আছি। আমি আরো অঙ্গীকার করিতেছি যেÑ ১. সর্বদা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি, সরকারের প্রতি ও মুক্তিবাহিনীর প্রতি অনুগত থাকিব; ২. আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করিব; ৩. আমাদের শত্রু পাকিস্তানিদের ধ্বংস সাধনে লিপ্ত থাকিব; ৪. কোনো প্রকার লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হইব না; ৫. কোনো লুটের মাল ছুঁইব না; ৬. নারী ও শিশুদের প্রতি কোনো অশোভন আচরণ করিব না এবং ৭. মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করিলে কোনো বাঙালিকে হত্যা করিব না এবং হত্যা করিতে সহায়তা করিব না। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
১২. শপথের পর যুদ্ধে পাঠিয়ে দিতেন একেকটি দলকে। প্রথমদিকে হায়দার নিজেই একেকটি টিম নিয়ে ঢাকা-কুমিল্লøা, কুমিল্লা-সিলেট, কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়ক ও রেলপথ, কালভার্ট, পুল ইত্যাদি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দিলেন। এতে তার দ্বারা প্রশিক্ষিত গেরিলারা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে স্বাধীনভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে শুরু করল। কয়েক মাসের মধ্যে হায়দার তার টিমের সহযোগিতায় ৩৫ হাজারেরও বেশি গেরিলা যোদ্ধাকে গড়ে তুললেন সুপ্রশিক্ষিত করে এবং গড়ে তোলেন বিশাল এক গেরিলা বাহিনী। এ বাহিনী পাকিস্তানিদের ঘুম ‘হারাম’ করে দিলো। হায়দার তার মায়ের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, ‘হায়দার, তোর প্রশিক্ষণ দেয়া ছেলেরা ঢাকায় বীরের মতো যুদ্ধ করছে। মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করছে। ওরা ধরা পড়ছে, পাকিস্তানিরা ওদের মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারছে না। ওরা জীবন দিচ্ছে, তবু মুখ খুলছে না। হায়দার, তোর এই ছেলেরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করবেই।’
১৩. ‘হিট অ্যান্ড রান’ থেকে ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ : পাকিস্তান সরকার রাত-দিন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে প্রচার করে যাচ্ছে, বহির্বিশ্ব যাতে কোনোভাবেই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম টের না পায়। ঢাকায় ছিল বাড়তি নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ২নং সেক্টর কমান্ডার এবং ‘কে’ ফোর্সের প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিলেন। পাক সরকারের মিথ্যাচারের জবাব ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানান দেয়ার উদ্দেশ্যে রাজধানী ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করার জন্য তার নির্দেশে ক্যাপ্টেন হায়দার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, দুঃসাহসী ও মেধাবী ১৭ জন তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুললেন এক দুর্ধর্ষ গেরিলা দল। এদের কাজ ছিল গ্রেনেড ছোঁড়া থেকে শুরু করে ঝটিকা আক্রমণ, অতর্কিত ত্রাস সৃষ্টি করা এবং ‘হিট অ্যান্ড রান’। মোট কথা, আরবান গেরিলা যুদ্ধের সব ধরনের কৌশলই এদের রফত করানো হয়। এ দলকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের আশপাশে একটি গেরিলা অপারেশন ‘হিট অ্যান্ড রান’ পরিচালনা করার জন্য প্রথমবারের মতো ঢাকায় পাঠানো হলো। কিন্তু ঢাকার অশান্ত পরিস্থিতি তুলে ধরতে তারা যেভাবে লক্ষ্যবস্তুর কেন্দ্রে হামলা করে বসে, তাতে তোলপাড় ওঠে চারদিকে। দুর্ধর্ষ অপারেশনটির কথা শুনে নড়েচড়ে যুদ্ধের সব পক্ষ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। অপারেশন শেষে আলম-মায়া-জিয়ারা যখন ক্যাম্পে ফেরেন, তখন প্রশিক্ষণদাতা হায়দারকে উদ্দেশ করে খালেদ মোশাররফ বলে ওঠেন, ‘লুক হায়দার, এদের বললাম টার্গেটের আশপাশে গ্রেনেড মারার জন্য। এরা তো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফুটিয়ে দিয়েছে। ‘ঞযবু ধষষ ধৎব ঈৎধপশ চবড়ঢ়ষব. ইৎধাড়! ইৎধাড়!’ সেই থেকে ঢাকার গেরিলা অপারেশনে যাওয়া যোদ্ধাদের পরিচিতি হয়ে গেল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে।
১৪. জুন মাসের প্রথম থেকেই ঢাকাতে শুরু হলো ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের হামলা। ক্র্যাক প্লাটুনের এ অপারেশনের ব্যাপক সফলতার পর একের পর এক গেরিলা কায়দায় হিট অ্যান্ড রান অপারেশন চালাতে থাকে হায়দারের বাহিনী। তছনছ করে দিতে থাকে হানাদার বাহিনীর সব পরিকল্পনা। ব্রিজ, কালভার্ট, রেললাইন, সড়ক পথ ধ্বংস করে রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে দেয় সেপ্টেম্বরের মধ্যে। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে বিচ্ছুর দল কাকডাকা ভোরে, রৌদ্রোজ্জ্বল অপরাহ্ণে কিংবা মধ্যরাতে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালিয়ে যেত। ছোট ছোট অপারেশনের মাধ্যমে তারা তটস্থ করে রাখত সেনাবাহিনীকে। আর স্বাধীনচেতা ঢাকার অবরুদ্ধ বাঙালিদের মনোবল তাতে হতো দৃঢ়। পাকিস্তানি বাহিনী একেবারেই অসহায়, ন্যুব্জ ও নতজানু হয়ে পড়ে নভেম্বর মাসের শুরুতে। তারা শুধু সেনানিবাসের খাঁচায় বন্দী হয়ে বলতে থাকে, ‘মুক্তি কাঁহা হ্যায়, মুক্তি কাঁহা হ্যায় ? এ গেরিলাদের হামলায় তটস্থ হয়ে জেনারেল নিয়াজী তাদের নাম দিয়েছিলেন ‘মুক্তি কা বিচ্ছু’।
১৫. কঠোর পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, নিখাদ দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, চৌকস সেনা অফিসার মেজর হায়দার। যার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, স্মরণশক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সাদামাটা জীবনযাপন, সবার প্রতি নির্মল ভালোবাসা ও গুরুজনদের সম্মান করার গুণাবলি দিয়ে সবাইকে আকর্ষণ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তার অসাধারণ প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
১৬. বিজয়ের দিন, ১৬ ডিসেম্বর সেক্টর-২ এর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হিসেবে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিত্রবাহিনী ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে অভ্যর্থনা জানানো, পাকিস্তানি বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজি ও তার সঙ্গীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজনসহ নানাবিধ জটিল ও কঠিন দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেন মেজর হায়দার।
১৭. স্বাধীনতার পর ভারতীয় বাহিনী রেডিও স্টেশন দখল করার আগেই ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মুক্ত বাংলাদেশে প্রথম রেডিও চালু হয়েছিল হায়দারের নেতৃত্বে। মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী ঘোষণা করলেন যে, এখন জাতির উদ্দেশে কিছু বলবেন সেক্টর-২ এর কমান্ডার ইনচার্জ মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে মেজর হায়দার তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুরু করলেন, ‘আমি মেজর হায়দার বলছি। প্রিয় দেশবাসী, আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশ এখন মুক্ত। আপনারা সবাই এখন মুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক।…’ তারপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বললেন, ‘সব গেরিলার প্রতি আমার নির্দেশÑ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কোথাও যেন আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট না হয়। লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এলাকায় এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। যত দিন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরে দায়িত্ব না নেবে, তত দিন পর্যন্ত গেরিলাদের যার যার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। জনগণের প্রতি আমার আবেদন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করুন। আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও দালালদের ধরিয়ে দিন। নিজ হাতে আইন তুলে নেবেন না।’
১৮. একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম অংশীদার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের মুহাম্মদ হায়দার। কিন্তু আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পরও বিদেশীদের প্ররোচনায় বহুধা বিভক্ত। নানা মতে, নানা পথে, নানা আদর্শে, দলাদলিতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এবং আত্মঘাতী খেলায় উন্মত্ত। হিংসাত্মক ও আত্মঘাতী ক্যু-তে আমরা হারিয়েছি বহু অসাধারণ দেশপ্রেমিক অফিসারকে। যে দেশ গড়ার জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন, সে প্রাণপ্রিয় দেশের সৈনিকদের হাতেই নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হলো তাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা শহীদের মর্যাদা দিয়ে জান্নাতের সুউচ্চ স্থান দান করুন সিংহ পুরুষ হায়দারকে।