ডেস্ক নিউজ
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন চলতি মাসের মাঝামাঝি এক রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। খিঁচুনি দিয়ে জ্বর, সঙ্গে পাতলা পায়খানা। করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে গভীর রাতে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাবেন কিনা- তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি। পরে তার ছেলে তানভীর হোসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার হটলাইন নম্বরে ফোন করে পরামর্শ চান। অপর প্রান্ত থেকে একজন চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর ব্যবস্থাপত্র দেন। সে অনুযায়ী ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে তাকে সেবন করানো হয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি কিছুটা আরাম বোধ করেন।
আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, মোবাইল ফোনে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। বিনামূল্যে এভাবে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ঘটনা অবিশ্বাস্য লেগেছিল।
আনোয়ার হোসেনের মতে, তার মতো হাজারো মানুষ হয়তো এভাবে সমস্যায় পড়ছেন। তাদের মধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে যারা অবগত তারা তাৎক্ষণিকভাবে ফোন করে সুবিধা নিতে পারেন। কিন্তু যাদের জানা নেই, তারা সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা নিতে পারছেন না। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটির প্রচারণা খুব জরুরি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের মহামারির সময়ে টেলিমেডিসিন সেবার বিপুল উত্থান হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে অনেক চিকিৎসকই এখন সেবা দিচ্ছেন। অধিকাংশ রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকের চেম্বারে যেতে হচ্ছে না। এ ছাড়া অনেক চিকিৎসক চেম্বারে না গিয়ে অনলাইনে রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করছেন। অনেক চিকিৎসক ভিডিও কলের মাধ্যমে রোগীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই টেলিহেলথ সার্ভিস।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সমকালকে বলেন, করোনাকালে টেলিমেডিসিন সেবা অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই সেবা গ্রহণ করা যায়। করোনার আগে গড়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ টেলিফোনে সেবা গ্রহণ করতেন। কিন্তু গত বছর করোনার সংক্রমণ শুরুর পর প্রতিদিন ৫০ থেকে ৯০ হাজার মানুষ টেলিফোনে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শ পেতে ফোন করতেন। এখন অবশ্য সংখ্যাটা একটু কমেছে; প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ হাজার মানুষ ফোন করে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইন ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। লকডাউন চলাকালে এর হার আরও বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের মার্চ মাস থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিনটি হটলাইন নম্বরে ফোন করে ২ কোটি ৮১ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৭ জন সেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৫৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৭ জন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্য বাতায়নের ১৬২৬৩ নম্বরটি। এই নম্বরে এক কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার ২৬০ জন স্বাস্থ্যসেবার জন্য ফোন করেছেন। আর জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হটলাইন ১০৬৫৫ নম্বরে স্বাস্থ্যসেবা পেতে ফোন করেছেন ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮০ জন। হটলাইনে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শ পেতে ফোন কলের ৭০ শতাংশ ছিল করোনা-সংক্রান্ত। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ করোনা পজিটিভ ছিলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, হটলাইনের নম্বরগুলোতে ২৪ ঘণ্টা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ছয় সহস্রাধিক চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের হটলাইনের কার্যক্রমের সমন্বয়ক। এই শাখার পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, মানুষের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই সেবা আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ জন্য একটি কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সেখানে ফোন করে মানুষ চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন। বিষয়টি চালু করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে এটি অনন্য ভূমিকা পালন করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউকেএইডের অর্থায়নে সিনেসিস আইটির কারিগরি সহায়তায় স্বাস্থ্য বাতায়নের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে টেলিফোনে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য বাতায়ন।
সিনেসিস হেলথের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত এক বছরে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পেতে বেশি কল এসেছে। একজন প্রসূতি বুঝতে পারেন না, তিনি কীভাবে খাবার গ্রহণ করবেন। কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন? হঠাৎ করে পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য তিনি কোথায় যাবেন কিংবা কী ধরনের চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন- এসব জানতে চেয়ে ফোন আসে। অনেক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা দুর্গম এলাকা থেকেও ফোন আসে। ওই সব এলাকায় এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। হাতুড়ে চিকিৎসক কিংবা ওষুধ বিক্রেতার পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে অনেকে সমস্যা পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে গ্রামের মানুষ ফোন করে এই হটলাইন নম্বর থেকে চিকিৎসা পরামর্শ নিচ্ছেন। রোগীর স্বাস্থ্য সমস্যা শুনে একটি ব্যবস্থাপত্র তৈরি করে তা মোবাইলে এসএমএস করে পাঠানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। এতে করে রোগীরা উপকৃত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, টেলিহেলথের মাধ্যমে হয়তো সব ধরনের চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হবে না। বিশেষ করে ইসিজি কিংবা এনজিওগ্রাম করতে হবে এমন রোগীকে হাসপাতালে যেতেই হবে। তবে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা পরামর্শ কিংবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এটিকে যুগোপযোগী করে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলে স্বাস্থ্য খাতে একটি বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, অধিকাংশ রোগীর হাসপাতালে আসার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অযথা হাসপাতালে ভিড় করছেন। টেলিহেলথ ও টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে হাসপাতালে ভিড় কমানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে হয়রানি ছাড়াই মানুষ ঘরে বসে চিকিৎসাসেবা পাবেন। এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। টেলিহেলথ সেবাকে আরও যুগোপযোগী করে তোলা হবে।