ডেস্ক নিউজ
আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে সরকার। গুরুত্ব বিবেচনায় এ খাতে বিশাল চমক দিতে যাচ্ছে সরকার। নেওয়া হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান। সে জন্য প্রথমবারের মতো মোট বাজেটের ৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে স্বাস্থ্য খাতে। চলতি অর্থবছর থেকে বরাদ্দ প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বাড়বে। করোনা আক্রান্ত কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়, সে জন্য মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোকে অত্যাধুনিক করা হবে। স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করতে নতুন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে। বর্তমানে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যও বাজেটে সুখবর থাকছে। তাঁদের দেওয়া হতে পারে বিশেষ প্রণোদনা।
আগামী ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ‘জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য, আগামীর বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে যে বাজেট বক্তৃতা দেবেন, সেখানে স্বাস্থ্য খাতের এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা থাকবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজেটে এসব উদ্যোগ নিলে ভালো। তবে আমাদের টাকা খরচের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে, খরচের গুণগত মান বজায় রাখতে হবে এবং খরচের জটিলতা দূর করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি রোধ করতে হবে। সেবা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।’ তিনি বলেন, বাজেটে যে মাস্টারপ্ল্যানের কথা বলা হচ্ছে, তা যেন ঘোষণায়ই সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবায়িত হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর তাতে যেন জনগণ উপকৃত হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সূত্র মতে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। এখন পর্যন্ত বাজেটে মোট স্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির ২.৩৪ শতাংশ এবং মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ১১০ ডলার। এ কারণে করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দও সব সময় গুরুত্বহীন থেকেছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাত ঘিরে মাস্টারপ্ল্যান নিচ্ছে সরকার। এসব বিষয় মাথায় রেখেই প্রথমে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে প্রথমবারের মতো মোট বাজেটের ৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দ পেতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। গত সাত অর্থবছর ধরে এ বরাদ্দ কখনো ৫ শতাংশের ওপরে যায়নি। আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৭.৪ শতাংশ। আর জিডিপির ১.৩ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বরাদ্দ রয়েছে। এটি মোট বাজেটের ৫.২ শতাংশ। সে হিসাবে চলতি অর্থবছর থেকে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ছে তিন হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। বাড়তি এই বাজেটের বড় একটি অংশই অবশ্য খরচ হবে পরিচালন ব্যয়ে। বাকিটা মূলত ব্যয় হবে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে।
অর্থ বিভাগের বাজেট তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত সাত অর্থবছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। এটি ওই অর্থবছরের মোট বাজেটের ৪.৯২ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫.০৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার ১৪ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৫.৩৯ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪.৬৮ শাতংশ। একইভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৮১১ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট বাজেটের ৫.৬০ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১০ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। এটি ওই অর্থবছরের মোট বাজেটের ৫.১০ শতাংশ।
করোনা মহামারির সময় দেখা গেছে, জনসংখ্যা অনুপাতে দেশের হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ শয্যার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে ৫০৮টি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৭৩৭টি আইসিইউ শয্যা আছে।
এখন সরকার যে মাস্টারপ্ল্যান করবে বলছে, সেখানে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সরঞ্জাম বাড়ানো হবে। ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ জন্য এসব সরঞ্জাম আমদানি করমুক্ত থাকবে। এর পাশাপাশি করোনা মোকাবেলায় নতুন দুই হাজার চিকিৎসক, ছয় হাজার নার্স ও ৭৩২ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে। এর জন্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। চলতি বাজেটে গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকের সংখ্যা ও সেবার মান বাড়াতে বরাদ্দ রয়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা।
করোনাকালে এখন পর্যন্ত ১৪০ জনের বেশি চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। চলতি বাজেটে চিকিৎসকদের সম্মানি ভাতার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসকদের এককালীন সম্মানী ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। আগামী বাজেটে এ ভাতার পাশাপাশি দেওয়া হতে পারে ঝুঁকি ভাতা। সেই সঙ্গে আসতে পারে প্রণোদনার ঘোষণা। প্রণোদনা এবং এসব ভাতার জন্য আগামী বাজেটে বরাদ্দ থাকছে ৮৫০ কোটি টাকা।
করোনা মোকাবেলা, বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা কেনা বাবদ সরকার চলতি অর্থবছর ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রেখেছে। করোনার প্রকোপ এখনো কমেনি, বরং দিন দিন তা পৃথিবীজুড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এ বিবেচনায় যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার আগামী বাজেটেও ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখবে। আগামী বাজেটে সব নাগরিকের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে চার হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এটি ছয় হাজার কোটি টাকা করা হতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে আধুনিক সেবা ও অনলাইনে বিশেষায়িত সেবার ঘাটতি দেখা গেছে করোনাকালে। এ সেবার মান বাড়াতে এ খাতেও বরাদ্দ বাড়ানো হতে পারে। চলতি অর্থবছর এ খাতে ১৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামী বাজেটে তা ২০০ কোটি টাকা করা হতে পারে।
দেশের স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে গবেষণার জন্য বাজেটে আবারও বরাদ্দ দিতে যাচ্ছে সরকার। আগামী বাজেটেও এ খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছর ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠন করে সরকার। এ জন্য বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে এ তহবিল থেকে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের গবেষণার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র পাঁচ কোটি টাকা।