বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক জিয়ার নাম এখন পত্রপত্রিকায় যেমন প্রায় লেখাই হচ্ছে না, রাজনীতির অঙ্গনেও তেমন শোনা যাচ্ছে না। বিগত বছর নির্বাচনের আগে-পরে যিনি ছিলেন আলোচনার লাইমলাইটে, তার নাম এখন প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে যাচ্ছে। এক বছর আগে বিএনপির প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নেতাদের কেউ কেউ যেমন ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ নিয়ে নেতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন, এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তীব্র সমালোচনামূলক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে; তেমনি স্কাইপিতে প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নিয়েও তিনি তখন পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। বিএনপি যখন ছিল সংসদ বয়কটের লাইনে তখন নির্বাচিত এমপিদের সংসদে যোগদান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে শপথ নিতে না দেয়ার সময়ও তারেক রহমানের নাম উচ্চারিত হয়েছে। লন্ডনের সভায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত বক্তব্য এবং সরকারের প্রতি হুমকি-ধমকি দিয়েও ইতোপূর্বে তিনি প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে এসেছেন।
কিন্তু কোন মন্ত্রবলে যেন বর্তমান দিনগুলোতে হাওয়া ভবনের নায়কের নাম হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে পত্রপত্রিকায় তারেক রহমানের নামটি খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপ লাগবে। ‘বছরজুড়ে বিএনপি ছিল এলোমেলো’ শিরোনামে ৮ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে প্রসঙ্গক্রমে তার নাম উঠেছে। আর ৭ জানুয়ারি ঢাকা দক্ষিণের বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনের নাম ঘোষণা করার সময় মির্জা ফখরুল ‘তারেক জিয়াকে ফিরিয়ে আনার’ দাবিটি দৈনিক ইনকিলাব পরিবেশন করেছে। এক সময়ে তারেক জিয়া-সাদেক হোসেন খোকা বিরোধের কারণে দলকে নামাতেই তিনি এই নাম উচ্চারণ করেছেন বলে ধারণা করা যায়। গত ৬ জানুয়ারি মহাসচিব মির্জা ফখরুল খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেও দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানের নামটি মুখে আনেননি।
এমনকি ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন ৬ জানুয়ারি কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন বললেও তারেক রহমানের ব্যাপারে তেমন কিছু করবেন বলেননি। ‘আত্মার আত্মীয়’ জামায়াতও এখন তার নাম নেয় না। ইতোমধ্যে বিস্ময়ের সঙ্গে জানা যাচ্ছে, ঢাকার দুই করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী ও কমিশনাররা দলের কার্যকরী প্রধানের নামটি উচ্চারণ করছেন না। আর এতদিন পর বিএনপির অন্যতম গার্জেন ডা. জাফরউল্লাহ বলেছেন, ‘দুই বছরের জন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে তুমি এফফিল বা মাস্টার্স করো।’ হঠাৎ করে এই কথা বলার কারণ বলা শক্ত হলেও বিএনপির অভ্যন্তরে কতক দ্ব›দ্ব-বিভেদ হাতিহাতির ঘটনায় অনুমান করা যাচ্ছে কেন তিনি এই কথা বলছেন। বিএনপির অভ্যন্তরের যারা খোঁজখবর রাখেন, তারাই জানেন তারেক রহমান নীরবে নিজের বশংবদদের নিয়ে দল গোছাতে তৎপর। সারাদেশে বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি গঠন করছেন। ছাত্রদলের কমিটিও গঠন করেছেন। নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তও দিচ্ছেন।
এটা কার না জানা যে, বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ছিল ক্ষমতায় এবং হাওয়া ভবনকে ক্ষমতার ‘প্যারালাল কেন্দ্র’ করে তিনি যখন মাকে ক্ষমতার মসনদে ‘পুতুল’ বানিয়ে সর্বেসর্বা হয়েছিলেন, তখন বিএনপি সংগঠনকে হাতের মুঠোয় নিতে পিতার সহযোগী প্রবীণদের কোণঠাসা করে নবীন ও প্রবীণ নিজের বশংবদদের সামনে এনেছিলেন। এখনো তিনি একই কায়দায় লন্ডনে বসে গুটি নাড়িয়ে তা করছেন। দল হিসেবে বিএনপি যখন বিধ্বস্ত, তখনো তিনি নিজ স্বার্থ রক্ষা ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে বিদেশে বসে সব চাল দিয়ে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিক্রিয়া বিএনপি সংগঠনে হচ্ছে।
বিএনপি দলটি প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪২ বছর হয়েছে। সেনাশাসক জিয়া উর্দি পরে ক্যান্টনমেন্টে বসে ক্ষমতা সবটুকু ব্যবহার করে দলটি যখন প্রতিষ্ঠা করেন, তখন দলের কতই না ছিল রমরমা। ‘ক্লিন পার্টি’ দিয়ে দেশকে ফিলিপস বাতির মতো ফকফকা করে দেবে বলে দলটি তখন সব সরকারি শক্তি ব্যবহার করে মাঠে নেমেছিল। মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের মাত্র ৭ বছরের মধ্যে স্বাধীনতার মর্মবাণী ও চেতনাকে পদদলিত করে তখন দলে সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী, ক্ষমতালোভী রাজনীতিক পেশাজীবী সামরিক-বেসামরিক আমলারা যোগ দিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু জনগণের একটা অংশ বিশেষত তরুণ সমাজ এই রমরমা ভাব ও প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে দলে যোগ বা সমর্থন দিয়েছিল। জিয়াউর রহমানই ক্ষমতা কুক্ষিগত দীর্ঘস্থায়ী করতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। এরশাদ ক্ষমতা দখল ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ‘ভাই’ জিয়ার পথই অনুসরণ করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর যখন তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে জাতির পুনর্গঠনের সময় তখনই এই দুই অবৈধ সেনাশাসক মিলে এক যুগের বেশি দেশ শাসন করেছেন। এই দুই শাসক একটা প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত করেছেন, রাজনীতিকে নৈতিকভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছেন। রাজনীতিকে মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে ‘নর্দমায়’ নিয়েছেন। রাজনীতির এই অশুভ ধারা রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে এমনভাবে গভীর ও বিস্তৃত করেছেন, যা থেকে এখনো জাতি মুক্ত হতে পারছে না। তারেক জিয়া আসলে জিয়া-এরশাদের রাজনৈতিক ধারারই সৃষ্টি।
কলামটা লেখার সময়ে হঠাৎই মনে পড়ল উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তার কথা। ওই তারবার্তায় বলা হয়, তারেকের কারণে ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্য বিনষ্ট হওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে।’ রাষ্ট্রপতি এরশাদকে নিয়ে কত যে আছে দুর্নীতিসহ অপকর্মের কেচ্ছা। আর বাংলাদেশ ছোট দেশ, মানুষ জানে কোন রাজনৈতিক নেতা কীভাবে অপকর্ম-দুষ্কর্ম করছে। কিন্তু তারেক ছাড়া আর কোনো নেতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বলে জানা যায়নি। বাস্তবে দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য অনিষ্টকর সবকিছুই করেছে এই ‘সুযোগ্য’ সন্তানটি! তবুও শাস্তি মাথায় নিয়ে প্রবাসে থাকা সত্তে¡ও তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন পদে বসানো হয়েছে।
এমনকি দলীয় গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা, যাতে লেখা ছিল দুর্নীতিপরায়ণ কেউ দলের নেতৃত্বে থাকতে পারবে না’, কথাটি বাদ দিয়েছে। ড. কামাল প্রমুখরা ‘রোগমুক্ত রাজনীতির’ কথা বলেন, জামায়াত বলে ‘সৎ লোকের শাসনের’ কথা। কিন্তু জোটের কেউ প্রকাশ্যে বলেন না, তারেক জিয়ার দেশ ও গণবিরোধী অপকর্মের কথা। তাকে বিএনপির এক নম্বর পদ থেকে সরানোর কথা। বিএনপির অভ্যন্তরে তারেক জিয়ার একচ্ছত্র প্রভাব ও শক্তি আজ প্রমাণিত। এই শক্তি কিসের শক্তি? কেবল কি পরিবারতন্ত্র? পরিবারতন্ত্র ঠিকই আছে। কিন্তু এর ভেতরে যে অবৈধ-অনৈতিক তথা দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থের চেইন আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় তারেক জিয়া সম্পর্কে উল্লেখিত কথাগুলো বলা হলো এ কারণে যে, দেশের মানুষ বিশেষত পাকিস্তানি আমলে যারা গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বাধিকারের আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ভোট ও ভাতের সংগ্রামে শামিল ছিলেন; তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা ক্ষমতায় থাকুক চাইলেও এর সঙ্গে গণতন্ত্র চায়, সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য অবিতর্কিত ভোট চায়। সংসদের ভেতরে-বাইরে শক্তিশালী বিরোধী দল কামনা করে। সুদীর্ঘকাল সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্র-ভোট আমাদের জাতীয় ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিশে আছে। সর্বোপরি ক্ষমতা করো জন্য কখনো মৌরসি পাট্টা নয়। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই চিরকাল ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়। আর জিয়া-এরশাদের রাজনীতি থেকে এটাও প্রমাণিত যে, এক দ্ব›দ্ব-সংঘাত-হিংসা-দ্বেষ আরো আরো দিক থেকে বহু এসবের জন্ম দেয়।
দলীয় অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে দল ও দেশের স্বার্থে এখন বিএনপি যদি তারেককে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়, জামায়াতকে যদি জোট থেকে বাদ দেয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যদি সমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে, অশুভ পাকিস্তান কানেকশন পরিত্যাগ করে দেশের স্বার্থের ক‚টনীতি নিয়ে দাঁড়ায়, অতীতের সব ভুল যদি স্বীকার করে; তবে যথাযথ মর্যাদা নিয়ে বিরোধী দল দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা বিএনপি ওপরে তছনছ যা-ই হোক না কেন, সবশেষ ঢাকা সিটি নির্বাচনও দেখিয়ে দিচ্ছে বিএনপি তৃণমূলে এখনো বিধ্বস্ত হয়নি।
সর্বোপরি বিশ্ব ও উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় রাজনীতির যে উত্থান হচ্ছে, তাতে বিএনপি দলকে তৃণমূলে ভেঙে তছনছ করা কিংবা নতুন কোনো অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী দল গড়ে উঠবে বলে মনে করার কোনো কারণ দেখা যায় না। বিএনপি যদি উল্লেখিত পথ গ্রহণ করে তবে আওয়ামী লীগ বিশেষত বিচক্ষণ সাহসী ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ধারণা করি চাইবেন বিরোধী বা প্রতিদ্ব›দ্বী দল হিসেবে বিএনপি পুনরায় গুছিয়ে উঠুক। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ অগ্রসর হোক এটা চায় দল-মত নির্বিশেষে জনগণ আর তাই তেমন বিরোধী দল জনগণও চাইবে।