ডেস্ক নিউজ
কুষ্টিয়া শহরের গোসালা সড়কের বাসিন্দা তারিকুল হক। তাঁর করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। বাসায় আইসোলেশনে থাকার সময় হঠাৎ করে গভীর রাতে তিনি শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। খবর পেয়ে ওই রাতেই তাঁর বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাজির হন একদল তরুণ। কুষ্টিয়ায় এমন সেবা দেওয়ার অসংখ্য উদাহরণ গত ১৫০ দিনে সৃষ্টি করেছেন ছাত্রলীগের একদল কর্মী।
এই কর্মীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছাত্রলীগ কর্মী মো. আ. হাফিজ ওরফে চ্যালেঞ্জ। তাঁর নেতৃত্বে অন্তত ৬৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে জেলা, উপজেলা, কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীরা আছেন। হাফিজ কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক।
ছাত্রলীগের এই স্বেচ্ছাসেবকেরা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশন ওয়ার্ডে নেওয়া, অক্সিজেন সরবরাহ করা ও মৃত ব্যক্তিদের দাফনের কাজ করছেন। এ ছাড়া কুষ্টিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের দিন থেকেই কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ২৪ ঘণ্টা সেবা দিচ্ছেন।
আজ মঙ্গলবার এই স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের ১৫০ দিন। এত দিনে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশনে ৩১৫ জন ভর্তি হয়েছেন। ২২৩ জন সেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তাঁদের পাশে ছিলেন ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা। এ ছাড়া মৃত ৯ জন কোভিড–১৯ রোগীর দাফনও সম্পন্ন করেছেন তাঁরা।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও আইসোলেশন ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক এ এস এম মুসা কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ কর্মীরা যে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তা বিরল দৃষ্টান্ত। করোনাকালে এমন স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ায় তাদের নিয়ে গর্ব করতে হয়।’
হাসপাতাল ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২১ মার্চ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকার আইশোলসন ওয়ার্ডে কাজ করার জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবক খোঁজ করেন। ছাত্রলীগের হাফিজ তখন ৩৬ জন কর্মীকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। সেই থেকে শুরু তাঁদের কার্যক্রম।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের এই ৩৬ জন কর্মীকে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কীভাবে কোভিড রোগীর সেবা দিতে হবে, তাঁদের ওষুধ খাওয়াতে হবে, খাবার খাওয়াতে হবে, অক্সিজেন মেপে দেখতে হবে, প্রয়োজন হলে রোগীকে অক্সিজেন দিতে হবে—সব শেখানো হয়।
ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা জানান, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সামনে আরপিটিআই হোস্টেলে করোনা ওয়ার্ড ছিল। সেখানে ২৫ এপ্রিল প্রথম কোভিড রোগী ভর্তি হয়। ২২ মার্চ থেকেই হাসপাতাল ও আরপিটিআই হোস্টেলে জীবাণুনাশক স্প্রে করার কাজ শুরু করেন তাঁরা। ৩৬ জন কর্মীর মধ্যে ১৫ জন স্প্রে করার কাজ করতেন। বাকিরা ৮ ঘণ্টা করে আইশোলসন ওয়ার্ডে কাজ করতেন। এক মাস তাঁদের এমন কার্যক্রম চলার পর আরও কর্মী যোগ দেন। বর্তমানে এই কাজে কর্মীর সংখ্যা ৬৫। তার মধ্যে ৪২ জন সরাসরি আইশোলসন ওয়ার্ডে কাজ করছেন।
কথা বলে জানা গেছে, কাজ করার সময় এই কর্মীরা বাড়িতে যাননি। ২০ জন কর্মী গত দুই ঈদেও বাড়িতে যাননি। প্রথম দিকে শহরের একটি আবাসিক হোটেলে থাকতেন। বর্তমানে শহরের একটি বাসায় ২৫ জন পালাক্রমে থাকছেন। কাজ করতে গিয়ে তাঁদের নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেসব নিয়েও কথা বলেন তাঁরা। তাঁরা জানান, আইসোলেশন ওয়ার্ডে কাজ করার কারণে গ্রামের বাড়িতে গেলে পাড়া–প্রতিবেশী তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হেনস্তা করেছেন। অনেক রোগী হাসপাতালে একা ছিলেন। কোনো স্বজন একবারের জন্যও তাঁদের দেখতে আসেননি। আবার মৃত ব্যক্তির দাফনের কাজ করতে গিয়ে গ্রামের মানুষের বাধার মুখে পড়ার অভিজ্ঞতাও তাঁদের হয়েছে।
আইসোলেশন ওয়ার্ডে এই স্বেচ্ছাসেবকদের সেবা নেওয়া করোনা পজিটিভ এক মা ও মেয়ে বলেন, ‘নিরলসভাবে তাঁরা যে সেবা দিয়েছেন, তা কখনো ভুলতে পারব না। আপনজনও এমন সেবা করেন না। তাঁদের ঋণ শোধ করার মতো না।’
চলতি মাস থেকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের পেয়িং ওয়ার্ডে আইশোলসন ওয়ার্ড স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে বর্তমানে ৪৮ জন রোগী ভর্তি আছেন। ভর্তি থাকা ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা অন্তত ১০ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁদের সবারই মন্তব্য, চিকিৎসক-নার্সদের পাশাপাশি ছাত্রলীগের ছেলেরা যে সেবা দিচ্ছেন, তা অতুলনীয়। দিন–রাত যেকোনো প্রয়োজনে তাঁরা দ্রুত সাড়া দেন, পাশে দাঁড়ান।
এই কাজে নেতৃত্ব দেওয়া হাফিজসহ পাঁচজন এখন পর্যন্ত করোনা পজিটিভ হয়েছেন। ইতিমধ্যে দুজন সুস্থ হয়ে আবারও সেবাকাজে যোগ দিয়েছেন। বাকি দুজন আইসোলেশনে আছেন। হাফিজ বলেন, ‘বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থাকাটাই রাজনীতি। এই মন্ত্র থেকেই কাজ করে যাওয়া। যত দিন সরকারের তরফ থেকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক বা নিয়ন্ত্রণে আসার ঘোষণা না আসবে, তত দিন এই সেবা চলমান থাকবে।’
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আরএমও তাপস কুমার সরকার বলেন, ‘ছাত্রলীগের কর্মীরা যে সহযোগিতা করছেন, সেটা প্রশংসার দাবিদার। করোনাকালে যেখানে ভয়ে পরিবারের সদস্যরা স্বজনদের থেকে দূরে থাকছেন, সেখানে এমন সেবা দেওয়ার মন–মানসিকতা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’
জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, ‘নিরলসভাবে কাজ করা ছাত্রলীগ কর্মীদের খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তাঁরা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য কাজ করছেন।’