বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিলো গত ৮ মার্চ। সে হিসাবে গত ৮ সেপ্টেম্বর ছয়মাস পূর্ণ হয়। গত ছয় মাসের কিছুটা বেশি সময়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলায় সরকার কতটা সফল তা নিয়ে মতভেদ আছে। শুরুর দিকে চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি, ডাক্তার ও টেকনিশিয়ানের অপ্রতুলতা এবং সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের বিষয় উঠে আসে। পাশাপাশি নতুন ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু গত ছয় মাসে নানামুখী পদক্ষেপে চিকিৎসা সরঞ্জামের সংখ্যা সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ক্রমে বেড়েছে। গত এপ্রিলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছিল দেশে পরিপূর্ণ আইসিইউ ইউনিট রয়েছে মাত্র ১১২টি। গতকালের সরকারি হিসাবে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫০টিতে। পাশাপাশি জরুরি চিকিৎসার অন্যান্য সরঞ্জামাদিও ছিলো না। অথচ বর্তমানে অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ১৩ হাজারের বেশি, অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের সংখ্যা ৩৪১ এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদির সংখ্যাও ক্রমে বাড়ছে। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সংখ্যা ৫২৫টি, আরও কিছু ক্রয় প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, শিগগিরই চলে আসলে এর অভাব অনেকটাই দূর হবে। তবে, চিকিৎসা ও সুরক্ষা সরঞ্জামের সংখ্যা ক্রমে বাড়লেও জুলাই মাস থেকেই মানুষের মধ্যে সচেতনতা কমে গেছে এমন একটি অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া গত ছয় মাসেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে মানুষের অসচেতনতাকেই দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনার বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, স্বাস্থ্যখাতের সকলের প্রচেষ্টায় দেশে করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মৃত্যুর হারও কমেছে। এখন দেশে গড়ে ২০ থেকে ২৫ জনের মৃত্যু ঘটছে। অথচ পাশ্ববর্তী ভারতে দৈনিক এক হাজার থেকে ১২শ’ মানুষের মৃত্যু ঘটছে।
অপ্রিয় হলেও সত্য দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পাশাপাশি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্তে¡ও দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ যেভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে তা বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলার সাফল্যের প্রশংসা করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকও। করোনা নিয়ন্ত্রণে ‘ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে অপরিচিত ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে ভ‚মিকা রেখেছেন তা সবার কাছে প্রশংসিত। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার অনেক কম। বিশ্বের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সংক্রান্ত নানা তথ্য প্রদানকারী এ ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান অনুসারে, করোনায় বিশ্বব্যাপী গড় মৃত্যু হার ৪ শতাংশের বিপরীতে বাংলাদেশে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪১ শতাংশ।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গতকাল ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৮২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৭১ জনে। এখন পর্যন্ত মোট মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ৭৬০ জন বা ৭৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং নারী ১ হাজার ৬৩ জন বা ২২ দশমিক ০৪ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় মোট মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই সংখ্যা ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনা নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের পেছনের সঠিক কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত না হলেও তাদের মতে, জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য, মানুষের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বিস্তৃত টিকাদান ব্যবস্থাসহ এ ধরনের বিভিন্ন কারণে এখানকার মানুষ করোনাভাইরাস থেকে নিজেদের সুরক্ষা করার পাশাপাশি দ্রুত সুস্থও হয়ে উঠতে পারছেন।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যথাপোযুক্ত পদক্ষেপ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দৃঢ়তার সাথে সেগুলো বাস্তবায়ন করে স্বাস্থ্যখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে চিকিৎসা সেবাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টাকে সাফল্য হিসেবে দেখছেন অনেকেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। করোনা সঙ্কটের শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন বলেই বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই সংক্রমণ থেকে কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে। তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেকটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সে কারণেই পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশের পরিস্থিতি এখনো অনেকটা ভালো।
করোনা মোকাবিলায় সাফল্য প্রসঙ্গে জাহিদ মালেক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী পদক্ষেপে বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যা বেড়েছে ৪ গুণের বেশি। দু’একটি হাসপাতাল ছাড়া কোথাও সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা ছিল না। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় সব বড় হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপণ করা হয়েছে। করোনা রোগীদের জন্য রাতরাতি ২০ হাজার শয্যা তৈরি করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি সামলাতে আমেরিকার মতো দেশে ওষুধ রেসনিং করতে হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে ওষুধের কোন ঘাটতি নেই। বরং পর্যাপ্ত পরিমান ওষুধ রফতানি করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বাজেট খুবই স্বল্প। যেখানে আমেরিকার স্বাস্থ্য বাজেট তাদের জিডিপির ১৫ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও স্বাস্থ্য বাজেট দেশটির জিডিপির আড়াই শতাংশ। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য বাজেট জাতীয় বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। এই স্বল্প বাজেটে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমরা ভালোভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পেরেছি। একই সঙ্গে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার আমাদের আশা জাগাচ্ছে। দ্রুতই বিশ্ব ভ্যাকসিন পেয়ে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন পেতে ইতোমধ্যে চারটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যাও আমাদের ভ্যাকসিন দেয়ার কথা বলেছে।
জাহিদ মালেক বলেন, কিট আসলেই দেশে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হবে। যেখানে অর্থাৎ যেসব জেলা বা উপজেলায় আরটি পিসিআর ল্যাব নেই, যেখানে দ্রুত করোনা পরীক্ষা করা দরকার, সেখানেই অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।
জনবহুল দেশ হওয়ার পরও অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার অনেক কম উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ও সাবেক ভিসি প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেছেন, আমরা এর পেছনের সঠিক কোনো কারণ বলতে পারছি না। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। তবে আমি মনে করি, মূলত দুটি কারণ রয়েছে- জনতাত্তি¡ক এবং শারীরবৃত্তীয়। তিনি বলেন, করোনায় মৃত্যুর হার কেবল বাংলাদেশে নয়, আফ্রিকাসহ অন্যান্য দেশেও খুব কম। কারণ তাদের জনসংখ্যার বেশির ভাগই তরুণ।
তরুণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে এবং তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারে উল্লেখ করে প্রফেসর নজরুল বলেন, আমাদের ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের জনসংখ্যা রয়েছে ১০ শতাংশেরও কম। তবে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। তাই আমরা বলতে পারি যে করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্রদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী মনে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না যে বাংলাদেশে করোনার মৃত্যুর হার কেন এত কম। তবে অনুমান করতে পারি, অন্যান্য আক্রান্ত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের তীব্রতা কম। তথ্য যাচাই করলে দেখা যায়, যাদের শরীরে অন্য কোনো জটিল রোগ রয়েছে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন এবং যাদের সে ধরনের সমস্যা নেই তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রফেসর ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় প্রবীণরা সাধারণত বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুতর রোগে আক্রান্ত হন। এ জন্য সারা বিশ্বে করোনা রোগীদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তবে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপ এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে কারণ আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা (৭৫ বছরের বেশি) কম। আর এ জন্য আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুর হারও অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।