ডেস্ক নিউজ
পঞ্চাশ বছরের অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ। সাবমেরিন কেবল থেকে মহাশূন্য বিজয়। সর্বত্র লাল-সবুজ পতাকার জয়জয়কার। দারিদ্র্যের তলাবিহীন ঝুড়ি, বারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন পিতৃহন্তারক জাতি হারতে হারতেও জেগে উঠেছে ফিনিক্স পাখির মতো। জাতির পিতার স্বপ্ন, আদর্শ পূঁজি করেই তার উত্তরসূরির নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লড়াই। ইতোমধ্যেই প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পথ-নকশা তৈরি করেছে অর্ধ শতক পেরনো উন্নয়নশীল বিশ্বের ‘রোলমডেল’ বাংলাদেশ।
গত পঞ্চাশ বছরে দরিদ্রতার তকমা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর ঘটেছে। রূপকল্প ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশের স্বপ্নে বিভোর জাতি। এক দশকে দারিদ্র্য কমেছে ১৫ শতাংশের বেশি। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ আর জিডিপি বেড়েছে ৩০ গুণ। ১৯৭০ সালে এই অঞ্চলের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার, ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলারে। শতভাগ বিদ্যুৎ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্পায়ন, গৃহায়ন, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ প্রশমনে বদলে গেছে বাংলাদেশের চেহারা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ- যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার লড়াই সংগ্রামের সুবিশাল ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমূখী শিল্পায়ন, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বাড়াসহ অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রগতি, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রো রেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পে অগ্রগতিতে বদলে গেছে বাংলাদেশের চেহারা। দেশব্যাপী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। পঞ্চাশ বছরে খাদ্য উৎপাদনে বিষ্ময়করভাবে এগিয়েছে বাংলাদেশ। পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এদেশকে আমরা এমন ভাবে গড়ে তুলবো বাঙালি জাতিকে যেন আর কখনো বিশ্বের কারো কাছে মাথা নত করে চলতে না হয়। শতভাগ বিদ্যুতায়নের মতো দেশে একদিন কোনো গৃহহীন মানুষ থাকবে না। দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সবার সহযোগিতা চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে আজকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আমরা যে এগিয়ে যাচ্ছি এ যাত্রা যেন অব্যাহত থাকে, সমগ্র জাতির কাছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে সেটাই আমার আহ্বান থাকবে, অনুরোধ থাকবে।
চ্যালেঞ্জ পাহাড়সম : বিশ্লেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল বৈশিষ্ট্য বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক দেশ গড়াই আজকের চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বয়স পঞ্চাশে পেরিয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু যে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্য আজীবন লড়াই করেছেন, গত ৫০ বছরে দেশে এই বৈষম্য আরো বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর উল্টোপথে যাত্রা করে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাহাত্তরের সংবিধানে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড এবং জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ডের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে দেন জিয়াউর রহমান। পরে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় ফুলে-ফেঁপে আরো বড় হয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত করে তারা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের ওপরই আঘাত করেছে।
এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, গবেষক, লেখক শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, পঁচাত্তরের পর ইতিহাস পাল্টে ফেলার চক্রান্তে বন্দি হয় রাষ্ট্র-সমাজ। জিয়া-এরশাদের আমলের ইতিহাসবিকৃতির মহোৎসবের অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা এখনো সম্ভব হয়নি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে। পঞ্চাশ বছরেও আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরতে পারিনি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার শুরু এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়া। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনাই জাতির শপথ হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
যেতে হবে বহুদূর : বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও কমেনি ধনী-দরিদ্র বৈষম্য। অধরাই থেকে যাচ্ছে গণতন্ত্রের স্বপ্ন। গণতন্ত্রের কাঠামো তৈরি হয়েছে, কিন্তু কাঠামোয় প্রাণের স্পন্দন এখনো শুরু হয়নি।
এ ব্যাপারে ঐক্য-ন্যাপের সভাপতি, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আজীবন মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করেছেন। আজ কৌশলে তাদের সঙ্গে আপোষ চলছে। আমাদের অর্জন অনেক, তবে মূল সুর হারিয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতি থেকে আদর্শের চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, পঁচাত্তরের পর অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেই সুশাসন লংঘন করেছে। ন্যায়বিচারকে রক্তাক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করেছেন, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা সেই কাঠামো অনুযায়ী দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।