ডেস্ক নিউজ
করোনায় শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি তলায় নেমে গেলেও কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। কৃষি খাতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বেড়েছে।
মহামারি কেরোনাভাইরাসের এই মহাসংকটের সময়ে কৃষিই বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে। এই কঠিন সময়ে কৃষি খাতের কোনো ক্ষতি হয়নি। উল্টো উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে কর্মসংস্থান।
অন্যদিকে শিল্প ও সেবা খাত করোনার ছোবলে তছনছ হয়ে গেছে। শিল্প খাতের উৎপাদন তলানিতে নেমে এসেছে। চাকরি হারিয়ে দিশেহারা লাখ লাখ পরিবার।
সেবা খাতেরও একই অবস্থা। প্রায় দেড় বছর ধরে ছোট-বড় সব ধরনের হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বিপণিবিতান, পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ। বাস-ট্রেনসহ অন্য পরিবহনও চলছে না ঠিকমতো। বহু মানুষ কাজ হারিয়ে গ্রামে গিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বৃহস্পতিবার ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া যায়।
এই প্রথমবারের মতো দুই অর্থবছরের জিডিপির হিসাব একসঙ্গে প্রকাশ করল পরিসংখ্যান ব্যুরো। ২০১৯-২০ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাব আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রাথমিক হিসাব প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তাতে দেখা যাচ্ছে, চূড়ান্ত হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর প্রাথমিক হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
এই দুই বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তার আগের দুই অর্থবছর ২০১৮-১৯ এবং ২০১৭-১৯ অর্থবছরে এই হার ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯২ এবং ৪ দশমিক ২ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে শিল্প খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এক ধাক্কায় ৩ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশকে সবচেয়ে কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় তিনগুণ ১২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০১৭-১৯ অর্থবছরে ছিল ১২ দশমিক ০৬ শতাংশ
সেবা খাতের অবস্থাও বেশ খারাপ হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেবা খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। সেবা খাতের এই প্রবৃদ্ধিও এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৭-১৯ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
তবে, নয় মাসের (২০২০ সালের ১ জুলাই-২০২১ সালের ৩০ মার্চ) হিসাব কষে পরিসংখ্যান ব্যুরো গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে, তাতে অবশ্য শিল্প ও সেবা খাতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশ খানিকটা বেড়েছে।
বিবিএস বলেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্প খাতে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আর সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয়েছে।
প্রতিবছর দেশের অভ্যন্তরে পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়ে কত টাকার মূল্য সংযোজন হয়, সেটাই জিডিপির হিসাবে ধরা হয়। মোটাদাগে কৃষি, শিল্প ও সেবা- এই তিন খাত দিয়ে জিডিপি হিসাব করা হয়। এসব খাতকে গণনা করা হয় সব মিলিয়ে ১৫ খাত দিয়ে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
এর মধ্যে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীন থেকে ছড়াতে শুরু করে নতুন এক করোনাভাইরাস, অল্প সময়ের মধ্যে তা বিশ্বজুড়ে মহামারির রূপ নেয়।
ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউন শুরু হয়, বন্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, ফলে বিশ্ব বাণিজ্য এক কথায় অচল হওয়ার দশা হয়।
বাংলাদেশে মহামারির ধাক্কা শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চে। শনাক্ত রোগী বাড়তে শুরু করে বাংলাদেশও অন্যান্য দেশের পথ অনুসরণ করে, ২৬ মার্চ থেকে সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে নাগরিকদের ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।
সরকারি ভাষায় ওই ‘সাধারণ ছুটি’ চলে টানা দুই মাস, এই সময় অর্থনীতির চাকা একপ্রকার অচল হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের শিল্পোৎপাদনও প্রায় বন্ধই থাকে।
মহামারির প্রথম ধাক্কায় অর্থনীতির ওই পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সাময়িক হিসাব দিয়েছিল। তবে তাতে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন অর্থনীতিবিদদের অনেকে।
এখন পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, ওই অর্থবছর সরকারের ধারণার চেয়েও ১.৭৩ শতাংশ পয়েন্ট কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মহামারির ওই সংকটে অর্থনীতির চাকা যেটুকু সচল ছিল, তার মূল কৃতিত্ব কৃষিখাতের।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় দেড় বছর ধরে মহামারির ছোবলে শিল্প ও সেবা খাত তছনছ হয়ে গেছে; এখনও হচ্ছে। যতদিন না পর্যন্ত আমরা দেশের বেশির ভাগ মানুষষকে টিকা দিতে না পারব, ততদিন এই দুই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
‘তবে আনন্দের বিষয় হচ্ছে, এই দেড় বছরে আমাদের কৃষি খাতের কোনো ক্ষতি হয়নি; উল্টো এ খাতের উৎপাদন আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কৃষক ধান, পাটসহ অন্যান্য ফসলের ভালো দাম পেয়েছে। তার প্রতিফলনই আমরা বিবিএসের হিসাবে দেখতে পাচ্ছি।’
২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে হিসাব পরিসংখ্যান ব্যুরো দিয়েছে, সেটাকে ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় বাস্তবভিত্তিক’ বলে মনে হয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুরের।
তিনি বলেন, ‘মহামারির ওপর কারও হাত নেই। অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে এটা আঘাত এনেছে। এই মহামারির কারণে ভারতে প্রায় ১০ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি শুনে ভালো লাগছে।’
করোনার ধাক্কা সামলে দেশের অর্থনীতি এখনও যেহেতু পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাই প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে চলতি অর্থবছরে ‘সঠিক নীতি সহায়তা’ দিয়ে অর্থনীতিকে সঠিক পথে রাখার ওপর জোর দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘মহাসংকটের সময়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটাই সবচেয়ে বড় অর্জন বলে আমি মনে করি। এই কঠিন সময়ে ৩/৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও যদি হয়, সেটাকেও আমি “অসম্ভব অর্জন” বলে মনে করব।’
বিবিএসের মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, কী একটা ভয়াবহ কঠিন সময়ে পার করছে গোটা বিশ্ব। সব দেশের প্রবৃদ্ধিই হোঁচট খেয়েছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতসহ অনেক বড় বড় দেশের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর মধ্যে কৃষি খাত ভালো করায় আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছি।’
মহামারির এই সংকটের সময়ে শিল্প ও সেবা খাতসহ অন্যান্য খাতে কর্মসংস্থান কমলেও কৃষি খাতে বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা যায়, মহামারিকালে কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে বেসরকারি খাতে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। তারা গড়ে ৯৫ দিনের মতো কাজ পায়নি। পরে তাদের অনেকেই কাজ পেয়েছে। তবে আয় কমেছে। এর পরিমাণ গড়ে ১২ শতাংশ। করোনার কারণে শিল্প ও সেবা খাতে চাকরি কমেছে। আর কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬ জেলার ২ হাজার ৬০০ খানার (পরিবার) ওপর জরিপ চালিয়ে এই তথ্য পেয়েছে সিপিডি।
কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কেন বেড়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোভিডকালে রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের অনেকেরই চাকরি চলে যাওয়ায় তারা গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে। কেউ নিজের জমিতে চাষাবাদ করছে। অনেকে অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করছে। আবার অনেকে দিনমজুরির কাজে যোগ দিয়েছে।’
সে কারণেই শিল্প ও সেবাসহ অন্যান্য খাতে কর্মসংস্থান কমলেও কৃষিতে বেড়েছে বলে জানান তিনি।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে (বর্তমান বাজারমূল্যে) ৩০ লাখ ১১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা।
আর মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২৪ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ২২৭ ডলারে পৌঁছেছে।
গত অর্থবছর জাতীয় বিনিয়োগ (বর্তমান মূল্যে) জিডিপির ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এ সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ দশমিক ০৬ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশে। তবে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১-২১ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশে।