আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক একটি দেশ, এ হিসেবেই পরিচালিত হবে। এদেশে সব ধর্মের মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। কারণ সব ধর্মের লোক রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে।
গতকাল বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই দেশের মাটিতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সবাই একসঙ্গে বাস করবে। আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই বলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অবহেলার চোখে দেখব, তা নয়। সবাই সমানভাবে ধর্ম পালন করবে। যার যার ধর্ম পালনে সবার স্বাধীনতা থাকবে। আমরা সেই চেতনায় বিশ্বাস করি। ইসলামও সেই শিক্ষা আমাদের দিয়ে থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস থেকে শুরু করে নানা ধরনের জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস সবকিছু আমরা দেখেছি। সবাইকে যে কোনো পরিস্থিতি সহনশীলতার সঙ্গেই মোকাবিলা করতে হয়। আর কে কী বলল না বলল, সেগুলো শোনার থেকে আমরা কতটুকু দেশের জন্য করতে পারলাম সেটিই আমাদের চিন্তায় থাকবে। সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
বিজয় দিবসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথ গ্রহণের জন্য দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমাদের এটাই প্রতিজ্ঞা হবে জাতির পিতার যে স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ তিনি গড়তে চেয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ করব। জাতির পিতার আদর্শ বুকে নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করে এদেশের মানুষের পাশে থাকব। এদেশের মানুষ কখনো কারও কাছে মাথা নত করে চলবে না। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু কর সম্মানের সঙ্গে বাঙালি জাতি চলবে, যেটা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল- সেটাই আমরা পূরণ করব।
আলোচনা সভায় স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারার বেদনার কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার খুব কষ্ট লাগছে, দুঃখ লাগছে যে, সবাই ওখানে (আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়) বসে আছে। আর আমি দূরে জেলখানার মতো আরেকটা বন্দীশিবিরে (গণভবন) বসে আছি। এই বন্দীশিবির কতদিন? করোনা নামক এই বন্দিত্ব থেকে দেশ দ্রুত মুক্তি পায় আমরা আল্লাহর দরবারে সেই প্রার্থনাই করি। দ্রুতই করোনার ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বেরই তো একই অবস্থা। কাজেই এখান থেকে কীভাবে মুক্তি আসবে সেটিই বড় কথা। তবে করোনার ভ্যাকসিন আনার ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। ইতিমধ্যে আমাদের চুক্তিও হয়ে গেছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইতিমধ্যে অনুমোদনও দিয়েছে। কাজেই আমরা মনে করি এবং আশা করি- খুব তাড়াতাড়িই ভ্যাকসিন পেয়ে যাব। অযথা ঘোরাঘুরি না করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনেই সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, শুধু দলের নেতা-কর্মীই নয়, দেশবাসীকেও বলব স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে। সব থেকে বড় সুরক্ষা হচ্ছে সবাই একটু মাস্ক পরে থাকা, হাতটা পরিষ্কার রাখা এবং দূরত্ব বজায় রাখা। ঘোরাঘুরি কম করা, বেশি ঘুরঘুর না করে যার যার জায়গায় থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে নিয়ে সবাইকে চলতে হবে। এটা আমাদের সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জন্য যেমন দরকার, তেমনি দেশের মানুষের জন্যও দরকার। তারপরও সব থেকে সুরক্ষা হচ্ছে, সবাই একটু মাস্ক পরে থাকা, হাতটা পরিষ্কার রাখা এবং দূরত্ব বজায় রাখা। দেশের মানুষের প্রতিও আমার অনুরোধ, সবাইকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানতে হবে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারে সরকার হচ্ছে জনগণের সেবক। সরকার জনগণের সেবা করে, জনগণের মঙ্গল করতে পারে, দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। আজ আমরা দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে পেরেছি। কেননা আমরা জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে কাজ করছি। তিনি বলেন, জাতির পিতা সবসময় বলতেন, ভিক্ষুকের জাতির কোনো ইজ্জত থাকে না। সেই ভিক্ষুক জাতি হিসেবে আমরা থাকতে চাই না। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি, সেভাবেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা কারও কাছে মাথা নত করে চলব না। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাজ করে যাচ্ছি বলেই আমরা দেশকে শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত করেছি। রিজার্ভ আজ ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সব দিক থেকে দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এখন মুজিববর্ষ পালন করছি। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলব। দেশের কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না, গৃহহীনদের আমরা গৃহ নির্মাণ করে দেব। আমরা দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বালাব। ইতিমধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেই আমরা শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দেব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এবারও করোনা মহামারীর সময় কৃষকের ধান কাটা থেকে শুরু করে অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্য সাহায্য পৌঁছে দিতে আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ সবসময় মানুষের সেবার জন্য রাজনীতি করে, সেই সেবা আমরা করে যাব।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা দেশকে বিশ্বের বুকে উন্নত-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি হয়েছি। ২০২৪ সাল থেকে এটি কার্যকর হবে, এর জন্য যা যা করার আমরা তা করে যাচ্ছি। ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এ বদ্বীপের জন্য ১০০ বছরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছি। আজকে যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার সুন্দর জীবন ও ভবিষ্যতের জন্য কী কী করতে হবে, সেসব পরিকল্পনার কথাও এটাতে উল্লেখ করা রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সবসময় দেশের জনগণের জন্য কাজ করে, তাদের সুন্দর ও উন্নত জীবনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতাবিরোধী এবং আমাদের এদেশীয় তাদের দালাল এজেন্ট, যারা স্বাধীনতা চায়নি অর্থাৎ সেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর পদতলেই থাকতে চেয়েছিল, তারা বুঝতে পেরেছিল জাতির পিতার দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যেভাবে হবে, আর কোনো দিন এই বাংলাদেশকে তারা (পরাজিত শত্রু) দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সেই কারণেই ১৫ আগস্ট, আমাদের জাতীয় জীবনে একটা কালো দিন নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ আমার মা-ভাইসহ পরিবারের সবাইকে হত্যার পরও অনেক অপপ্রচার চালানো হয়েছে। ওই সময় খুনি ও তাদের দোসররা বলার চেষ্টা করেছিল, এটা একটা পারিবারিক ঘটনা। কিন্তু ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এটা পারিবারিক নয়, দেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ ও দেশকে পেছনে ঠেলে দিতেই এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিল। এরপর যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় বসানো হয়, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করে ইতিহাসের উল্টো পথে দেশকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলে।
দলকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। ইউনেস্কো আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদানের কথা ঘোষণা করেছে। এটা বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য একটা বিশাল প্রাপ্তি। তাই দলের নেতা-কর্মীদেরও বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বিজয় দিবসের আলোচনার শুরুতেই দেশবাসীকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতাকারী ভারত, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ভারতের ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীসহ সে দেশের সকল জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্তে উপস্থিত থেকে স্বাগত বক্তব্য রাখেন দলীয় সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও আবু আহমেদ মন্নাফী। গণভবন প্রান্ত থেকে সভা পরিচালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।