ডেস্ক নিউজ
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে বৈধ সাইনবোর্ডে অবৈধ অস্ত্র বিক্রিতে জড়িত বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে। অনেক বছর ধরে বৈধ অস্ত্রের এমন অবৈধ বেচাকেনা চললেও দেখভালকারী সংস্থাগুলো বুঝেই উঠতে পারেনি। ফাইলে স্তূপ করা নথি ঘেঁটেও সংশ্নিষ্টরা দেখেননি, অস্ত্রগুলো বৈধ নাকি অবৈধ। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার রোধে বিক্রেতা ও লাইসেন্সধারীদের বিশেষ সফটওয়্যারের আওতায় নেওয়ার কাজ শুরু করেছে সরকার। এরই মধ্যে ‘আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার’ ব্যবহার শুরু করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। সফটওয়্যারটিতে সারাদেশের অস্ত্রের হালনাগাদ তথ্য যুক্ত করার কাজ শুরু করেছে পুলিশ।
সংশ্নিষ্টরা জানান, সফটওয়্যারটিতে দেশের লাইসেন্সধারী সব আগ্নেয়াস্ত্র এবং এর ব্যবহারকারী, সব বৈধ ডিলার ও বিক্রেতাদের অস্ত্র বিক্রির তথ্য এবং শুটিং ক্লাবগুলোতে ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্র ও ব্যবহারকারীদের তথ্য নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে।
পুলিশের ভাষ্য, এই সফটওয়্যারের কাজ শেষ হলে দেশে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার বন্ধ হবে। অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার হলে অস্ত্রের গায়ে থাকা বারকোড বা সিরিয়াল নম্বর সফটওয়্যারে প্রবেশ করালেই জানা যাবে সেটি বৈধ নাকি অবৈধ। বৈধ অস্ত্র ব্যবহারকারীর হালনাগাদ পরিসংখ্যানের পাশাপাশি তার অবস্থানও মিলবে সফটওয়্যারে।
এসবির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুস সালাম সমকালকে বলেন, পুলিশকে আগে ম্যানুয়ালি অস্ত্রের লাইসেন্স এবং এর কার্যক্রম তদারকি করতে হতো। তবে নতুন সফটওয়্যারটি প্রতিটি বৈধ গুলি ও অস্ত্র শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। যদি কেউ অবৈধ অস্ত্রকে বৈধ বলে দাবি করার চেষ্টা করে, তখন সফটওয়্যারে সিরিয়াল নম্বর সার্চ দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরীক্ষা করা যাবে।
দেশেরই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সফটওয়্যারটি তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানা গেছে।
সফটওয়্যার ম্যানেজমেন্ট সংশ্নিষ্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, নির্বাচনসহ নানা সময়ে নিকটস্থ থানায় বৈধ লাইসেন্সধারীদের আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় সরকার। তখন অনেকেই থানায় অস্ত্র জমা দেন। কিন্তু সবাই তা দিয়েছেন কিনা অল্প সময়ে তা জানা সম্ভব হয় না। কারণ, লাইসেন্সধারীদের রেকর্ডগুলো ম্যানুয়ালিভাবে ফাইলে স্তূপ রাখা হতো। এতে সঠিক সময়ে নজরদারি করা যেত না। নতুন সফটওয়্যারে এক ক্লিকেই জানা যাবে কোন থানায় কতটি লাইসেন্স করা অস্ত্র রয়েছে, কতটি জমা পড়েছে।
ওই কর্মকর্তা উদাহরণ দিয়ে বলেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৪ হাজার বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের তথ্য রয়েছে। এর বাইরে লাইসেন্সধারী অস্ত্রধারী রয়েছেন কিনা তা কিন্তু দ্রুততম সময়ে বলার সুযোগ ছিল না।
অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশে অস্ত্রের বৈধ ডিলাররা প্রতিদিন কয়টি অস্ত্র বা গুলি বিক্রি করেন, তা বিক্রেতারা নিজেদের রেজিস্টার খাতায় লিখে রাখেন। একটা নির্দিষ্ট সময় পর থানায় অবহিত করা হয় ওই তথ্য। কিন্তু কে কিনল এই অস্ত্র বা গুলি, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানার সুযোগ নেই। নতুন সফটওয়্যার চালু হওয়ায় অস্ত্র বা গুলি বিক্রি করার সঙ্গে সঙ্গেই সব তথ্য আপলোড করতে হবে। এজন্য ডিলারদের সঙ্গে এরই মধ্যে পুলিশ বৈঠক করেছে।
দেশে বৈধভাবে অস্ত্র আমদানি ও বিক্রেতাদের সংগঠন বাংলাদেশ আর্মস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নাসির আহমেদ সমকালকে বলেন, সফটওয়্যারটি চালু হলে স্বচ্ছতা আসবে। সব তথ্য দ্রুত পাওয়া যাবে। বিষয়গুলো নিয়ে এরই মধ্যে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।
তিনি জানান, তাদের কাছ থেকে গত ৫ থেকে ১০ বছরের অস্ত্র-গুলি বিক্রির তথ্য চাওয়া হয়েছে। এসব তথ্য রেজিস্টার বুকে থাকলেও তা খুঁজে বের করা বেশ কষ্টকর।
সফটওয়্যার ব্যবহারে প্রশিক্ষণ নিয়েছে পুলিশ :সফটওয়্যারটির ব্যবহার জানতে এরই মধ্যে ৬৪টি জেলা ও আটটি মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশের ৭২ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পরিদর্শক থেকে শুরু করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারাই নিজ নিজ থানা এলাকার লাইসেন্স করা অস্ত্রধারীদের তথ্যগুলো সফওয়্যারের ডাটাবেজে সন্নিবেশ করছেন। ধীরে ধীরে আরও বেশি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় নেওয়া হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ডিলারদেরও :সফটওয়্যার সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, একই প্রশিক্ষণ পাবেন বৈধ অস্ত্র বিক্রেতা ও ডিলাররাও। কারণ অস্ত্র বা গুলি বিক্রির সঙ্গে সঙ্গেই তথ্য সফটওয়্যারে দিতে হবে। একইভাবে শুটিং ক্লাবের অস্ত্রধারীদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কারণ তাদের অস্ত্র ও গুলির তথ্যও থাকবে এই সফটওয়্যারে।
আর্মস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নাসির আহমেদ জানান, এসবির সঙ্গে বৈঠকের পর তারা প্রথম পর্যায়ে প্রশিক্ষণের জন্য ২১ জনের একটি তালিকা দিয়েছেন। ওই ২১ জন প্রয়োজনীয় ডাটা সফটওয়্যারে দেবেন। পাশাপাশি বিক্রেতারা আগের মতোই রেজিস্টার বইয়ে তথ্য লিখে রাখবেন।
দেড় মাসে ৩০ হাজার অস্ত্রের তথ্য সংযুক্ত :এসবির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিভিন্ন জেলায় পুলিশ গত ২৪ আগস্ট থেকে নিজ নিজ এলাকার লাইসেন্সকৃত অস্ত্র এবং এর ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্য সফটওয়্যারে আপলোড শুরু করেছেন। ৭ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় দেড় মাসে ৩০ হাজার বৈধ অস্ত্রের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে ২৯ হাজার ৬২৪টি অস্ত্রের লাইসেন্স ব্যক্তি পর্যায়ে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে ১৩৭টি অস্ত্র এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে ২৭টি অস্ত্র।