ডেস্ক নিউজ
স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জোরে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে ক্রমেই গুরুত্ব বাড়ছে এ দেশের। ঢাকাকে পাশে টানতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিগুলো। আর এসবই সম্ভব হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী হওয়ার কারণে। এর জেরেই তারা ধীরে ধীরে ভারতের প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে আসছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ইস্যু বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম মডার্ন ডিপ্লোম্যাসিতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠা নিয়ে একটি বিশ্লেষণী কলাম লিখেছেন নয়াদিল্লি-ভিত্তিক বিশ্লেষক ত্রিদিবেশ সিং মাইনি।
২০২০-২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। এদিক থেকে তারা ভারতকেও (১ হাজার ৯৪৭ ডলার) ছাপিয়ে গেছে। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে বিশ্বব্যাংক ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের সম্ভাব্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সংশোধন করে ১ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ ঘোষণা করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি হয়েছে বাংলাদেশের।
ভারত-শ্রীলঙ্কাকে বাংলাদেশের সাহায্যের প্রতীকী গুরুত্ব
সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ঢাকা শুধু অর্থনৈতিক উত্থান নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় তার সামগ্রিক প্রভাব বাড়িয়ে তুলতে চায়। প্রথমত, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ২০ কোটি ডলার মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ২০২০ সালে চীনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছে (১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৫০ কোটি ডলার মুদ্রা বিনিময়)। ভারতও দ্বীপরাষ্ট্রটির সঙ্গে ৪০ কোটি ডলার মুদ্রা বিনিময় করেছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে পর্যুদুস্ত ভারতে সাহায্য পাঠানো ৪০টি দেশের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশীয় দেশটি ভারতে সংক্রমণের সর্বোচ্চ হারের সময় ১০ হাজার ভায়াল রেমডেসিভির পাঠিয়েছিল। এছাড়া পিপিই কিট, জিংক, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি-সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও পাঠিয়েছে তারা।
শ্রীলঙ্কাকে দেয়া বাংলাদেশের সাহায্য পরিমাণের হিসাবে হয়তো খুব বড় নয়, তবে সেটি এ অঞ্চলের ভেতরে-বাইরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠিয়েছে যে, বাংলাদেশ এখন আর ভারতের ছত্রছায়ায় নেই (গত এপ্রিলের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বেশি)। একইভাবে, মহামারির মধ্যে বাংলাদেশ ভারতকে সাহায্য পাঠানোও প্রতীকী শর্তে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ।
চীন-ভারত ভারসাম্যের খোঁজে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অন্যদের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি, সম্প্রতি এক চীনা কূটনীতিকের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তাদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখলেও বাংলাদেশ চীনের কাছে মাথানত করার লক্ষণ নেই।
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত মাসে এক অনলাইন কনফারেন্সে বলেছিলেন, বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পরে। চীনা কূটনীতিকের এ মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে জনগণের স্বার্থরক্ষা করে নিজেই নিজের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেড়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগততে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে চীনের ব্যাপক বিনিযোগ রয়েছে এবং দেশটির উন্নয়নযাত্রার অন্যতম প্রধান অংশীদার হয়ে উঠেছে চীনারা।
একই সময় ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্কে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে ৯৪৫ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া রেল, সমুদ্র ও সড়কপথে দুই দেশের যোগাযোগও বেড়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা
বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা একটি বিষয় দিয়ে খুব ভালোভাবে পরিমাপ করা যায়। যে দেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একসময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন, সেই যুক্তরাষ্ট্রই আজ দক্ষিণ এশীয় দেশটিকে তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে যুক্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন। আলাপ শেষে তার বক্তব্য ছিল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে মোমেনের সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমরা যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী টেকসই সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেছি এবং দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যাশা করছি।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াড জোটে অংশগ্রহণের কথা ওঠায় বেইজিং মোটেও সন্তুষ্ট নয়। এক্ষেত্রে ঢাকা চীনকে উপেক্ষা করতে পারে না, তবে তারা বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা বাড়াতে পারে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠেছে: প্রথমত, এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মতো কোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে তাদের আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ আসে এবং কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তাদের বাধ্য করা যায় না।
উপসংহার
শুধু দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটেই নয়, বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে বৈশ্বিকভাবেও। অন্য দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় ও পররাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারছে না, এমনটি দেখলে বাকি প্রতিবেশীরাও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করবে।