ডেস্ক নিউজ
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিকল্প নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুযোগ আইনে যুক্ত করার জন্য একটি প্রস্তাব সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
বিদেশি মুদ্রা ব্যবহারে জটিলতা এবং বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা কাটাতে ডলারের পাশাপাশি যাতে অন্য দেশের মুদ্রা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক লেনদেন করা যায় সে বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রস্তাবে।
বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা শীর্ষক এফবিসিসিআইর প্রস্তাবের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে পারস্পরিক লেনদেনের সুবিধার্থে ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসিবি, ব্যাংক অব রাশিয়া, ব্যাংক অব চায়নার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু আন্তর্জাতিক লেনদেনে খরচ কমানোর পাশাপাশি ঝুঁকি ও নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ইউএস সুইফটের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লেনদেনের বিকল্প নেটওয়ার্ক ইসিবি এবং রাশিয়ান এসপিএফএস (সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অব ফাইন্যান্সিয়াল মেসেজ) ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে ৯ নম্বর ধারায়। লেনদেনের ক্ষেত্রে যেসব মুদ্রা ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই তার মধ্যে রয়েছে ডলার, পাউন্ড, রুপি, ইউরো, ইয়েন এবং রুবল। এসব মুদ্রা ব্যবহারে ‘বিনিময় চুক্তি’ এবং ‘কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত ‘বাণিজ্য (আমদানি ও রপ্তানি) ব্যবস্থাপনা, ২০২২’ শীর্ষক আইনে এই বিষয়গুলো যুক্ত করতে বলেছে দেশের শীর্ষ এই বাণিজ্য সংগঠনটি। আইনটির খসড়া তৈরির পর এর ওপর বিভিন্ন সংস্থা ও বাণিজ্য সংগঠনগুলোর মতামত চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। খসড়া আইনের ওপর গত ৩০ আগস্ট এসব প্রস্তাবনা পাঠায় এফবিসিসিআই। বাণিজ্য সংগঠনটির সিনিয়র প্রথম সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো একটি মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল থাকার সুযোগ নেই। আমাদের সিস্টেমগুলো ডেভেলপ করতে হবে। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায়নিজ মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। চীনের পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয়। এ ছাড়া অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় ভারতীয় রুপি সংগ্রহ করার সুযোগও বেশি। আমরা মনে করি, রাশিয়ান রুবলের চেয়ে ভারতীয় রুপিতে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হলে সেটি ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি কার্যকর হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক লেনদেনের বেশিরভাগই সংগঠিত হয় ‘দ্য সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন’ বা সুইফটের মাধ্যমে। সুইফট নেটওয়ার্ক দিয়ে সরাসরি অর্থ লেনদেন করা যায় না। এটা শুধু অনলাইনে পেমেন্ট অর্ডার পাঠায় ও মেসেজ কোডের মাধ্যমে সেই বার্তা গ্রাহককে জানিয়ে দেয়। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরুর পর থেকে লেনদেনের নিরাপদ ও প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে সুইফট। সারা বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশের ১১ হাজার আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুইফটের মাধ্যমে লেনদেন করে। বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনও পরিচালিত হয় সুইফট সিস্টেমে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে মিলে বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব বেলজিয়াম সুইফটের কাজকর্ম তদারক করে থাকে। তবে আর্থিক লেনদেনের এই নিরাপদ মাধ্যমটির বিকল্প কিছু ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার এসপিএসএফ এবং চীনের ক্রসবর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম বা সিআইপিএস। আমেরিকা রাশিয়াকে সুইফট থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়ার পর ২০১৪ সালে লেনদেনের নতুন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় দেশটি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর প্রথম এসপিএসএফ পেমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে লেনদেন শুরু হয়। বর্তমানে ৪০০-এর বেশি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান এই ব্যবস্থায় যুক্ত রয়েছে। রাশিয়ার পাশাপাশি চীনও লেনদেনের পৃথক মাধ্যম গড়ে তুলেছে। সিআইপিএস নামের চীনের এই লেনদেন মাধ্যমটিকে এখনো পর্যন্ত সুইফটের পর সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। রাশিয়াও এই সিস্টেমে যুক্ত হয়েছে। সূত্র জানায়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন প্রক্রিয়াটি কী হবে- সে বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চীনের মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেওয়ার পর চায়নিজ লেনদেনে নেটওয়ার্ক সিআইপিএস-এ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর। তবে রাশিয়ার লেনদেন নেটওয়ার্ক এসপিএফএস-এ বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা হলেও এ বিষয়ে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ওই নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে বিকল্প ‘কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতিতে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনের সুযোগ স্থাপন করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মাহবুব আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এফবিসিসিআই ডলারের পাশাপাশি অন্য দেশের মুদ্রা ব্যবহারের যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটি ঠিকই আছে। এটি সরকারের পলিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সুইফটের বিকল্প হিসেবে রাশিয়ান (এসপিএফএস) নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি এ বিষয়ে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আগ্রহ রয়েছে কি না তাও বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের এই সদস্য বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা ঝুড়িতে ডলারের পাশাপাশি পাউন্ড ও ইউরোসহ কিছু মুদ্রা রয়েছে। ফলে এসব মুদ্রাতেও সীমিত পরিসরে লেনদেন হয়। এখন চীনের মুদ্রার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, চীনের পাশাপাশি ভারতীয় মুদ্রা রুপিতেও লেনদেন সুবিধা কার্যকর হতে পারে। কারণ চীন ও ভারত এই দুই দেশ থেকেই বাংলাদেশের সিংহভাগ আমদানি হয়। এর ফলে ডলারের ওপর চাপ কমে যাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ওকাব-এর ‘মিট দ্যা প্রেস’-এ বলেন, আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে; সে ক্ষেত্রে ইউরোসহ অন্যান্য মুদ্রার কথা এসেছে। এটা খুবই টেকনিক্যাল বিষয়; সম্ভব কিনা সেটা জানি না। যেহেতু কথা উঠেছে তাই সম্ভাবনা আছে, চেষ্টাও চলছে। কারণ ডলারের দাম ওঠানামা করছে। দাম নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় চিন্তা করছে, আশা করছি ভালো একটা রেজাল্ট আসবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের নির্দেশনা স্টেট ব্যাংকের : বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনে টাকা ও রুপি ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান স্ট্যাট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। রপ্তানির তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি।
সম্প্রতি জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকটি বলেছে, চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং রিজার্ভ সংকটের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন ডলার এবং অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার এক্সপোজার (পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা) না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রতিবেশী দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ভারতীয় মুদ্রা ও টাকায় বাণিজ্য কার্যক্রম চলমান থাকবে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশটির নেতৃস্থানীয় ব্যাংকটি তাদের রপ্তানিকারকদের মার্কিন ডলার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন না করার বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ) মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তারা ভারতের স্টেট ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনটির কথা শুনেছেন। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলেও জানান তিনি। তবে ভারতের স্টেটব্যাংক যেভাবে উল্লেখ করেছে বাণিজ্যিক লেনদেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সে অর্থে কোনো সংকট নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।