ডেস্ক নিউজ
রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে প্রাসাদে যান মারিও। যুদ্ধ করে জয়ী হয়ে যেই না রাজকুমারীকে নিয়ে ফিরবেন, তখনই ঘোষণা আসে, ‘সরি মারিও, রাজকুমারী তো এখানে নেই। অন্য রাজপ্রাসাদে।’ আবার মারিও অন্য রাজপ্রাসাদে গিয়ে যুদ্ধ করে। এভাবে ধাপে ধাপে ৩২টি যুদ্ধ হয়। আসলে, রাজকুমারী এখানে একটা ধারণামাত্র। এই যে যুদ্ধ করে করে এগিয়ে যাওয়া, এটাই আসল। এটাই মারিও গেমের মূল ব্যাপার। মিনহাজ ফাহমি আর তানিম খান জীবনটাকেই মনে করেন এই গেমের মতো। এখানে ‘গন্তব্য’ বলে কিছু নেই। জীবন নামের যাত্রায় প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাওয়াই বড়।
এই দুই তরুণ হাউ টু মেক আ গেম নামে একটি বই লিখেছেন। সেটি একাডেমিক প্রকাশনী এপ্রেস থেকে বেরিয়েছে। আর আছে আমাজন ডট কমের আরপিজি প্রোগ্রামিংয়ের বেস্ট সেলিং তালিকায়।
খেলতে খেলতে ব্যাটারি লো
২০১৫ সালের ঘটনা। মিনহাজ ফাহমি তখন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্র। তখন বাংলাদেশে মাইক্রোসফট একটা ক্যাম্প করেছিল। ইমাজিন কাপ নামে শিক্ষার্থীদের সফটওয়্যারনির্ভর প্রকল্প তৈরির প্রতিযোগিতার আয়োজন করে মাইক্রোসফট। সেই প্রতিযোগিতায় মিনহাজ, ইশতিয়াক আর মিমোর বানানো গেমটা রানার্সআপ হয়ে গেল। ফাহমি ভাবলেন, ‘তার মানে তো কাজটা আমরা ভালোই পারি।’ তাই গেমকেই ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কাজ করার সময় বাংলাদেশে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাননি। তাই তিন বন্ধু মিলে সে বছর কোম্পানি খুললেন। নাম, ‘ব্যাটারি লো ইন্টারঅ্যাকটিভ’।
চাকরিই খুঁজে নিয়েছে দুজনকে
মিনহাজ ফাহমি ও তানিম খান—দুজনের কেউই কখনো চাকরি খোঁজেননি। মিনহাজ ফাহমি তাঁদের কোম্পানির সিইও। আর তানিম বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত বর্ষে যে প্রকল্প বানিয়েছেন, তা দেখে একাধিক প্রতিষ্ঠান তাঁকে নিয়োগ দিতে ডেকেছে। সদ্য স্নাতক করা তানিম বললেন, ‘আমি কোনো দিন ভাবিনি যে চাকরি না পেলে কী হবে। আমি ঝুঁকি নিয়েছি, কিন্তু ব্যর্থ হলে কী হবে, ভাবিনি। আমি গেম ছাড়া আর কিছুই করিনি। অনেকে অ্যাপ, ওয়েবসাইট তৈরি—এটা–সেটা শিখেছে। আমি এগুলো কিছুই শিখিনি। মিনহাজ ভাই তো নিজে স্ট্রাগল করে কোম্পানি খুলেছেন। একটু একটু করে দাঁড় করিয়েছেন। আর আমাকে ব্রেইন স্টেশন ২৩ নামের একটা সফটওয়্যার কোম্পানির গোটা একটি ব্যবসায় বিভাগ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, আপনি চালান। আমার বিভাগে এখন ১৮-২৫ জন কর্মী আছেন। ২০২২ সালের মধ্যে আমরা আরও লোকবল নিয়োগ করব।’
বই লেখার প্রস্তাব এল লিংকডইনে
২০১৯ সালে ঢাকা লিটফেস্টের একটা অধিবেশনের নাম ছিল মেটামরফোসিস ভিআর। বক্তা হিসেবে প্রাগ থেকে এসেছিলেন ইয়ান টমকিনস। সেখানেই সহবক্তা হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের মিনহাজ ফাহমি। অধিবেশন শেষে তাঁরা ডিনারে গেলেন একটা পাঁচ তারকা হোটেলে। এক টেবিলে যাঁরা খেতে বসলেন, তাঁদের একেকজনের একেকটা দারুণ সব গল্প। একজন ফিনল্যান্ডের ৯০ বছর বয়সী জনপ্রিয় লেখিকা। আরেকজন জীববিজ্ঞানী, যিনি এইডস গবেষক। আরেকজন ছিলেন কেমব্রিজের প্রফেসর, তিনি আবার স্টিফেন হকিংয়ের সহকর্মী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে গল্প, আড্ডা…সব মিলিয়ে পুরো অভিজ্ঞতা ফাহমি তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন। হঠাৎ একদিন লিংকডইনে তাঁর একটা মেসেজ আর একটা মেইল এল। সেখানেই পেলেন ভিআর কিংবা গেমস নিয়ে বই লেখার প্রস্তাব।
স্প্রিঞ্জার নেচার হলো একাডেমিক বইয়ের সবচেয়ে বড় প্রকাশনাগুলোর একটি। এরই যে অংশটা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে, তার নাম এপ্রেস। এটিও একটি মাল্টিন্যাশনাল প্রকাশনা সংস্থা। তবে স্প্রিঞ্জার নেচারের হেডকোয়ার্টার যুক্তরাজ্যের বেসিংস্টোকে, আর এপ্রেসের যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। বিশ্বের সেরা প্রকাশনা সংস্থা থেকে বই লেখার প্রস্তাব পেয়ে ফাহমির মনে হলো, ‘টু গুড টু বি ট্রু’। ব্যাপারটা বন্ধুদের বললেন। বন্ধুরা ‘ভুলেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিবি না’ বলে সতর্ক করল। এরপর ফাহমি বই লেখার সেই প্রস্তাব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন, দেখলেন, সব ঠিকই আছে। আলাপ এগোল। বইটা যাতে আরও সমৃদ্ধ হয়, এ জন্য ফাহমি তানিমকে সহলেখক হিসেবে নিলেন।
এই বই কেন সেরার তালিকায়
এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে বইয়ের বিষয়বস্তুর ওপর। ফাহমি আর তানিম ভাবলেন, তাঁরা গেমিং নিয়ে কী লিখতে পারেন, যেটা আগে লেখা হয়নি। তাঁরা কী জানেন, যেটা আর কেউ জানে না। কেননা তাঁরা নিজেরাই কাজ করেছেন বাংলাদেশে থেকে। গেমিং নিয়ে বইয়ের বাজারে তাঁরা কীভাবে নতুন কিছু যোগ করবেন, ভাবতে ভাবতে মনে হলো, তাঁরা লিখবেন—‘কীভাবে গেম বানানো যাবে না’। হাউ টু মেক আ গেম বইয়ে তাঁরা লিখেছেন, পাঁচ বছরে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা কী কী বাধা বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন, সেগুলো নিয়ে। ব্যর্থতার গল্প লিখেই সফল হলেন তাঁরা। তাঁদের বই পড়ে যাঁরা প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করছেন, তাঁরা যেন আগেই পাঁচ বছর এগিয়ে থাকতে পারেন—এই হলো উদ্দেশ্য। এভাবেই নিজেদের বইকে অন্য সব বই থেকে আলাদা করেছেন। এ ছাড়া গেম নিয়ে ভাবা, কোডিং, গেম বানানো, বারবার পরীক্ষা করা, আরও ভালো আউটপুট দেওয়া, গেম প্রকাশ করা—এসব ক্ষেত্রেও পাঠকের সহায়ক এই বই।