ডেস্ক নিউজ
মহামারি করোনার মধ্যে চারদিকে যখন খারাপ খবরের ছড়াছড়ি, তখন দেশের জন্য বড় সুখবর জানাল পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর। নতুন করে আরও ৬টি পণ্যের মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি মিলেছে ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী সিল্ক, কালোজিরা চাল, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, বিজয়পুরের (নেত্রকোনা) সাদামাটি এবং সতরঞ্জি। ফলে এই ছয় পণ্যের একক মালিকানা এখন থেকে বাংলাদেশের। ট্রেডমার্ক অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে আরও ৩টি পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। এগুলো হচ্ছেÑ জামদানি, ইলিশ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরসাপাতি আম। সব মিলে এখন ৯টি জিআই পণ্য হলো বাংলাদেশের। বিশে^র আর কোনো দেশ বা ব্যক্তি এই নামে এই ৯ পণ্যের মালিকানা দাবি করতে পারবে না। গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন ৬টি পণ্যের জিআই নিশ্চিত করে ট্রেডমার্ক অধিদফতর। কোনো দেশ যদি এই ৯ পণ্যের উৎপাদন বা ব্যবহার করতে চায় তা হলে তার স্বত্ব দিতে হবে বাংলাদেশকে। অধিদফতর সূত্রে আরও জানা গেছে, ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আরও কৈ মাছসহ ২৯টি পণ্যের আবেদন রয়েছে। এগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আগামী ২৬ এপ্রিল বিশ^ মেধাস্বত্ব দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ৬ পণ্যের জিআই পাওয়া বিষয়টি ঘোষণা এবং এর সনদ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান লকডাউনের কারণে সেদিন সনদ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের (ডিপিডিটি) রেজিস্ট্রার মো. আব্দুস সাত্তার সময়ের আলোকে বলেন, বাংলাদেশের জিআই পণ্য এখন মোট ৯টি। আরও ২৯টি পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আবেদন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে কৈ মাছ। তবে ২৯টি আবেদনের মধ্যে সবগুলো হয়তো চূড়ান্ত করা যাবে না, এর মধ্যে গুটিকয়েক হয়তো চূড়ান্ত জিআই স্বীকৃতি নিশ্চিত করা যাবে। তিনি বলেন, নতুন ৬ পণ্যের সনদ দেওয়ার বিষয়টি আমরা আগামী ২৬ এপ্রিল মেধাস্বত্ব দিবসে দেওয়ার চিন্তা করেছিলাম, কিন্তু লকডাউনের কারণে সেটি এখন আর করা যাচ্ছে না। ঈদের পর পরিস্থিতি বুঝে আমরা সুবিধাজনক সময়ে সনদগুলো বিতরণ করব। কারণ সনদ সশরীরে দিতে হয়। যদি সেটিও সম্ভব না হয় তা হলে হয়তো আমরা ভার্চুয়ালি সনদ বিতরণ করব।
ডিপিডিটি রেজিস্ট্রার আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, আইন অনুসারে গেজেট প্রকাশিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে দেশ বা বিদেশ থেকে এ বিষয়ে আপত্তি জানাতে হয়। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই ৬ পণ্যের বিষয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি। সে অনুসারে এ পণ্য এখন বাংলাদেশের স্বত্ব।
এই স্বত্ব পেলে বাংলাদেশ নানাভাবে লাভবান হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন বা ডব্লিউআইপিও’র সব শর্ত মেনে আমরা জিআই স্বত্ব দিয়েছি। এসব পণ্যের সব তথ্য সংস্থাটির ওয়েবসাইটেও দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে বিশে^র যেকোনো দেশের নাগরিক পণ্যগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। যেকোনো দেশের ব্যবসায়ীরা পছন্দ অনুযায়ী এসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করতে পারবে। এর ফলে এসব পণ্যের রফতানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
ডিপিডিটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক সামগ্রী হিসেবে স্বীকৃতি পায় জামদানি। ২০১৭ সালে জিআই স্বীকৃতি মেলে ইলিশের এবং ২০১৯ সালে ক্ষীরসাপাতি আমকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে তিনটি পণ্য এ তালিকায় ছিল। শেষ দফায় নতুন করে ছয়টি পণ্য যুক্ত হওয়ায় মোট জিআই পণ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ৯টিতে।
নতুন করে যে ছয়টি পণ্যের জিআই স্বত্ব মিলেছে তার মধ্যে রাজশাহী সিল্কের ভৌগোলিক স্বত্ব পেতে আবদেন করা হয় ২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। আবেদন করে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড, রাজশাহী। গত ৬ জানুয়ারি এ বিষয়ে জার্নাল প্রকাশ করে ডিপিডিটি।
কালিজিরা চাল বা ‘বাংলাদেশ কালিজিরা’ জিআই সনদ পেতে আবেদন করা হয় ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। আবেদন করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর। এটিরও জার্নাল প্রকাশ করা হয় গত ৬ জানুয়ারি। দিনাজপুরের কাটারিভোগের জিআই সনদ পেতে আবেদন করা হয় ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। এটিরও আবদেন করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর জার্নাল প্রকাশ করা হয় গত বছরের নভেম্বর মাসে। বিজয়পুরের সাদামাটির জিআই পেতেও আবেদন করা হয় ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। আবেদন করা হয় নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে। এর জার্নাল প্রকাশ করা হয় ৬ জানুয়ারি।
ঢাকাই মসলিনের জিআই সনদ পেতে আবদেন করা হয় ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি। আবেদন করে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। এটিরও জার্নাল প্রকাশ করা হয় গত ৬ জানুয়ারি। এ ছাড়া সরঞ্জিরও জিআই সনদের বিষয়ে জার্নাল প্রকাশ করা হয় গত ৬ জানুয়ারি।
প্রসঙ্গত, কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা হলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
জিআই একটি পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ ট্রেডমার্ক যেমন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় পরিচিতি দেয়, জিআই একটি দেশের নির্দিষ্ট পণ্যকে পরিচিতি প্রদান করে। জিআই পণ্যের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিশ^বাজারে পণ্যটির ব্র্যান্ডিংয়ে, যা সমমানের অন্য যেকোনো পণ্য থেকে জিআই পণ্যকে এগিয়ে রাখে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তত্ত্বাবধান ও উদারীকরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশ^বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ২৩টি চুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘বাণিজ্য-সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি বা ট্রিপস (ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস)। এই চুক্তির ২৭.৩ (খ) ধারায় পৃথিবীর সব প্রাণ-প্রকৃতি-প্রক্রিয়ার ওপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। এই চুক্তিতে বিশে^র বিভিন্ন দেশে যেসব প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি এবং কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘকাল ধরে উৎপাদিত হয়ে আসছে তার ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক আইন করে নিবন্ধন করে রাখার বিধান রয়েছে।