ডেস্ক নিউজ
১৫ বছর আগে যখন শুরু করেছিলাম তখন মানুষকে বুঝিয়ে, নামমাত্র দামে দিনে দু-তিন কেজি মাশরুম বিক্রি করতে পেরেছি। এখন ২০ থেকে ২৫ কেজি প্রতিদিন বিক্রি করছি। ছোট বারান্দার উৎপাদন নিয়ে এসেছি বড় খামারে। দিনে ২০০ কেজি উৎপাদনের জন্য শেড করছি।’
দেশে মাশরুমের চাহিদা ও বাজারচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের শফিউল আজম খান। গ্রামের বাড়ি আখাউড়াতে তাঁর খাদেম মাশরুম সেন্টার।
গত ১০-১৫ বছরে শফিউলের মতো এমন অনেক উদ্যোক্তা মাশরুমের চাষ করে সফল হয়েছেন। বাজার ও সরবরাহ চেইন তৈরি করেছেন। মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের হিসাবে ১০ বছরে দেশে মাশরুমের বাজার চার গুণ বড় হয়েছে। উদ্যোক্তা ও চাষিরা মিলে গড়ে তুলেছেন বছরে ৮০০ কোটি টাকার মাশরুম বাজার।
মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯-১০ সালে দেশে মাশরুম উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ সালের হিসাব বলছে, চার গুণ উৎপাদন বেড়েছে। এ সময় ৪০ হাজার টন মাশরুম উৎপাদন হয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে মাশরুমের উৎপাদন ছিল ৪২ হাজার টন। ইনস্টিটিউটের ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এখন মাশরুমের বাজার ৮০০ কোটি টাকার।
ইনস্টিটিউটের হিসাবে বর্তমানে দেশব্যাপী বড় খামারি রয়েছেন এক হাজারের ওপরে। বড় খামারি বলতে কমপক্ষে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ কেজি মাশরুম উৎপাদন করেন এমন ব্যক্তিকেই ধরে তারা। ছোট অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন দেশের আনাচে-কানাচে।
দেশে যে পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন হয় তার পুরোটাই দেশের চাহিদা মেটাতে লাগে। বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় রপ্তানির আগ্রহও উদ্যোক্তাদের মধ্যে কম। তবে দেশের বাইরেও মাশরুমের বেশ চাহিদা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, নেদারল্যান্ডস ও ভারত এই ১০টি দেশে মাশরুমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের মাশরুম উৎপাদকরা বলছেন, দেশে মাশরুমের বাজার বড় হচ্ছে। এ খাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়ছে। সেই সঙ্গে ভোক্তাদের অনেকে খাদ্য তালিকায় মাশরুম যোগ করছেন। আর ওষধি গুণের কারণে ডায়াবেটিকসহ নানা রোগের পথ্য হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে মাশরুম।
খিলগাঁওয়ের শফিউল আজম খান বললেন, ডায়াবেটিক রোগীর আটা তৈরির অনুমোদন পাওয়া একটি প্রতিষ্ঠান তাঁর কাছে থেকে শুকনো মাশরুম কিনতে যোগাযোগ করেছে। যতটুকু তিনি তৈরি করতে পারবেন তার সবটুকুই নিয়ে যাবে প্রতিষ্ঠানটি।
বগুড়া মাশরুম কটেজের উদ্যোক্তা (স্নাতক শিক্ষার্থী) আবুল হাসনাত বলেন, ছয় বছর আগে বগুড়া হর্টিকালচার সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যখন চাষ শুরু করেন তখন চার থেকে পাঁচ কেজি মাশরুম উৎপাদন ও বিক্রি হতো। এখন প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কেজি মাশরুম বিক্রি হয়। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে তাঁর মাশরুমের বাজার তৈরি হয়েছে।
আবুল হাসনাত জানালেন বীজসংকটের কথা। তিনি বলেন, ‘এ জন্য আমি বীজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বিক্রি করে দেব।’
রাজধানীর খুচরা বাজারগুলো ঘুরে সাত প্রজাতির মাশরুম দেখা গেছে। সবচেয়ে সহজলভ্য ওয়েস্টার, শীতাক ও ঋষি। ওয়েস্টার গরম ও শীত সব মৌসুমেই উৎপাদন হয়। তাই বছরব্যাপী এটি বাজারে পাওয়া যায়। শীতাক শুধু শীত মৌসুমে বাজারে আসে। ওষধি গুণ বেশি হওয়ায় ঋষি হারবাল পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে কিনে নেয়। অবশ্য এই জাতের মাশরুম চাষের জন্য দেশের আবহাওয়া অনুকূল নয়। শীতপ্রধান দেশে এই মাশরুমের চাষ ভালো হয়।
বাজারে সাধারণত পলিব্যাগে ২৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত মাশরুমের প্যাকেট পাওয়া যায়। চাষিরাই পলিব্যাগে ভরে সরবরাহ করেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মতিঝিল, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন বাজার ও এলাকায় ওয়েস্টার মাশরুমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। দাম বেশি হওয়ায় এখনো এই সবজিটি অভিজাত শ্রেণির খাদ্য হিসেবেই রয়ে গেছে বলে বিক্রেতারা জানান। আবার ঢাকার বাইরে দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় অনেক মধ্যবিত্তের খাবার তালিকায় ওয়েস্টার মাশরুম জায়গা করে নিয়েছে।
খোলাবাজারের সবজি বিক্রেতাদের কাছে মাশরুম এখনো সহজলভ্য নয়। কিন্তু বিভিন্ন সুপার শপে সহজে পাওয়া যায়। তবে সব সুপার শপে কাঁচা মাশরুম বিক্রি নিয়মিত নয়। কিন্তু শুকনা মাশরুম পাওয়া যায়।
কারওয়ান বাজারে মাশরুম কিনতে আসা আলমগীর নামের এক ক্রেতা বলেন, নির্দিষ্ট কিছু বিক্রেতা ছাড়া মাশরুম পাওয়া যায় না। তাই অনেক সময় আমদানি করা মাশরুমের ক্যান কিনতে হয়। তাতে টাকা অনুযায়ী মাশরুমের পরিমাণ কম থাকে।
সাভার, আখাউড়া, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উৎপাদন পর্যায়ে ওয়েস্টার মাশরুম বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজিদরে। এক কেজি মাশরুম উৎপাদনে খামারির খরচ হয় ৬০ থেকে ৮০ টাকা। এর মধ্যে মূল খরচ বীজ ও খড়ে। বীজ প্রতি কেজি ৪০ টাকা করে কিনতে হয়। প্রতিটি বীজ থেকে তিন থেকে চার মাস ফলন আসে। এ ছাড়া শ্রমিক খরচ রয়েছে কিছুটা।
বাজারে সবচেয়ে দামি ঋষি মাশরুম। দেশে এই জাতের মাশরুম উৎপাদন কম হয়। এগুলো প্রতি কেজি খুচরায় দাম চার থেকে ছয় হাজার টাকা। চাষি বা খামারি পর্যায়ে এ জাতের কাঁচা মাশরুম বিক্রি হয় সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা কেজিদরে। বাজারে আমদানি করা মাশরুমের চার থেকে পাঁচটি ব্র্যান্ডের ক্যান পাওয়া যায়। যার বেশির ভাগই চীন থেকে আমদানি করা। ওয়েস্টার ও ঋষি দুই প্রকার মাশরুমই ক্যান হিসেবে বিক্রি হয়। ওয়েস্টার ৪০০ গ্রামের ক্যান প্রায় সব বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়।
সাভারের মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সাবেক উপপরিচালক নিরদ চন্দ্র সরকার বলেন, মাশরুম একটি পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ওষধি গুণসম্পন্ন খাবার। চাষ করার জন্য কোনো আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না। অনুৎপাদনশীল ফেলনা স্বল্প জমিতে বিপুল পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করা যায়।
মাশরুমে বিনিয়োগ
মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রথম ১৯৮০ সালে সাভারের সোবহানবাগ হর্টিকালচার সেন্টারে মাশরুম চাষ শুরু হয়। তার বছর দশেক পর ১৯৮৯-৯০ সালে জাপানের সহায়তায় মাশরুম উন্নয়নে এক কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। গত ৩২ বছরে মাত্র ৯০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় মাশরুম উন্নয়নে। এখন পর্যন্ত ওয়েস্টার, ঋষি, মিলকি ও শীতাক প্রজাতির মাশরুমের ৯টি জাতের বীজ অবমুক্ত করা হয়েছে। আরো পাঁচ-সাতটি গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে।
কিছু সমস্যার কথা জানালেন মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মাশরুমের বাজার সম্প্রসারণে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। এর দায়িত্ব আমাদের কিছু রয়েছে, আবার কৃষি বিপণনের কিছু রয়েছে। বেসরকারি খাতেরও কিছু রয়েছে। তবে আমাদের কাছে চলমান কোনো প্রকল্প না থাকায় বেশি প্রচারণায় যেতে পারছি না।’