ডেস্ক নিউজ
করোনাভাইরাস মহামারি আগামী অর্থবছরের বাজেটের হিসাব-নিকাশের অনেক কিছুতেই ‘প্রথম’ যোগ করছে। অর্থাৎ প্রথমবারের মতো সরকার অনেক কিছুতে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে আসছে। বাস্তবতা মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে না। প্রথমবারের মতো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা বাদ দিয়ে বাস্তবের কাছাকাছি রাখা হচ্ছে। বরাবরই বাজেটের আকারকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করার চেষ্টা থাকে। এবার তা থেকেও সরে আসছে সরকার। বরং আগামী বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে করোনা মহামারিকে। এই সংকট উত্তরণের বিষয়টি মাথায় রেখেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা তথা চিকিৎসা, দেশি শিল্প, গ্রামীণ অবকাঠামো এবং কর্মসংস্থানে। তবে এত কিছু করার কারণে এবার বাজেট ঘাটতি প্রথমবারের মতো দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করে নতুন অর্থবছরে অর্থনীতিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল রবিবার বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক করেন। বৈঠকে বাজেটের হিসাব-নিকাশে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতি অর্থবছরেই বাজেটের আকার রেকর্ড গড়েছে। সর্বশেষ তিন অর্থবছরেই বাজেটের আকার বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল তিন লাখ ৯১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক লাখ ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেড়ে বাজেটের আকার দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আর গত বছর করোনা সংকটের মধ্যে ঘোষণা করা ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট আগের বছরের চেয়ে ৪৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়। করোনা সংকট না কাটলেও এর কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকারে এতটা উল্লম্ফন ঘটাতে রাজি নন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাই চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ৩৩ হাজার ৫১১ কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে ছয় লাখ এক হাজার ৫১১ কোটি টাকার বাজেট প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা যে কয়টি বিষয় নিয়ে আপত্তি তোলেন, তার মধ্যে রাজস্ব আয় অন্যতম। সরকার সব সময় অবাস্তব এবং উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে থাকে বলে তাঁরা মনে করেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ রাজস্ব আয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে এক লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্ধেকের কম। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আগামী বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে না। আগামী বাজেটে এনবিআরকে তিন লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে। তবে বাড়ানো হচ্ছে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা। চলতি অর্থবছরে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে তা বাড়িয়ে তিন লাখ ৮৯ হাজার ৭৮ কোটি টাকা করা হচ্ছে। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।
তবে এবারের বাজেট ঘাটতি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে। প্রথমবারের মতো ঘাটতি জিডিপির ৬.১ শতাংশ ধরা হচ্ছে। আগামী অর্থবছর জিডিপির আকার ধরা হচ্ছে ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে দুই লাখ ১২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হচ্ছে দুই লাখ ২৫ হাজার ১২৪ কোটি টাকা।
দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তার অন্যতম ‘বিজ্ঞাপন’ হিসেবে তুলে ধরা হয় জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে। করোনার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি অর্জনে যে কয়েকটি দেশ এগিয়ে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অন্যান্য দেশ যখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে খাবি খাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে বাংলাদেশে এই হার ৫.২৪ শতাংশ বলে জানানো হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৮.২ শতাংশ। করোনার কারণে তা কমিয়ে ৬.১ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। আর আগামী অর্থবছরের বাজেটে তা ৭.২ ধরা হচ্ছে। আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হচ্ছে ৫.৩ শতাংশ।
করোনায় যাতে স্বাস্থ্যসামগ্রী বা টিকা বাবদ অর্থ ব্যয়ে কোনো সমস্যা না হয় সে জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাখা হচ্ছে বিশেষ বরাদ্দ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে করোনা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী বাজেটেও করোনার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখা হতে পারে।
করোনা মহামারিতে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) করা যৌথ গবেষণার তৃতীয় ধাপে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী বাজেট হবে গরিববান্ধব বাজেট। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চলতি বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.১ শতাংশ। আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে। ফলে এর আওতা আরো বাড়বে। এ ছাড়া বাজেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, দেশি শিল্প, গ্রামীণ অবকাঠামো এবং কর্মসংস্থানে বিশেষ নজর থাকবে। আগামী বাজেটে প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত রাখার ঘোষণাও থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা।