ডেস্ক নিউজ
বর্ষা পেরিয়ে শরৎ। সেপ্টেম্বরে পূর্ণিমায় জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রুপালি ইলিশ। অন্য বছরের মতো এবারও এমন সময় দেশের বাজারে ইলিশের জোগান বেড়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) স্বীকৃতি পেয়েছে ইলিশ। বিশে^ ইলিশের মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশই বাংলাদেশে। দেশের চাহিদার মেটানোর পাশাপাশি কূটনীতিতেও ব্যবহার হচ্ছে মাছের রাজা ইলিশ। বিশে^ বাংলাদেশের ইলিশের চাহিদা থাকলেও দেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে স্বল্প পরিসরে ভারতে রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশ-বিদেশ মিলে বর্তমানে ইলিশের বাজার প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার, জিডিপির ১ শতাংশেরও বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশের অর্থনীতিতে যেভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এ খাতকে একটা শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে সরকারকে সুনজর দিতে হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মৎস্য) শ্যামলচন্দ্র কর্মকার আমাদের সময়কে বলেন, বিশে^ ইলিশ উৎপাদনে আমরা এক নম্বরে আছি। সরকারের পদক্ষেপ ও কঠোর নজারদারি না থাকলে গল্প শুনতে হতো ইলিশ একটি সুস্বাদু মাছ। ইলিশের আহরণ বাড়াতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। সেখানে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাব, আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষা পাচ্ছে। এ ছাড়া ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ফলে উৎপাদন বাড়ছে। তবে দাম একটু বেশি। চাহিদা বেশি হওয়ায় দাম একটু বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন, দাম বৃদ্ধি ও ইলিশের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততার কারণে অর্থনীতিতে মাছটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ আর জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশের বেশি। দেশের জিডিপির আকার ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। হিসাব অনুসারে ইলিশের বাজার সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। ইলিশ আহরণে নিয়োজিত ৬ লাখ মানুষ। আর পরোক্ষভাবে ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ইলিশ আহরণে প্রথম বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে আহরিত ইলিশের ৮০ শতাংশই বাংলাদেশে। ১০ শতাংশ মিয়ানমারে, ৫ শতাংশ ভারতে এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য দেশে। স্বাদ ও ঘ্রাণে বাংলাদেশের ইলিশ অতুলনীয়, বিশ্বসেরা।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রপ্তানি আয় বাড়ানো ও আমিষের চাহিদা পূরণে জাতীয় মাছ ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। জাটকা সংরক্ষণসহ ইলিশ রক্ষায় বছরব্যাপী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় প্রতি বছর মাছটির উৎপাদন বাড়ছে। গত ১০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ টন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন।
মৎস্য অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বেশকিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করায় ইলিশ উৎপাদন বেড়েই চলছে। পাশাপাশি নতুন কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়বে। মৎস্য অধিদপ্তরের উপপ্রধান (ইলিশ) মাসুম আরা মনি বলেন, এক সময় শুধু মেঘনায় ইলিশ পাওয়া যেত, এখন সারাদেশেই পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মায় যেন আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায় সে জন্য নানামুখী কাজ চলছে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিরদিনের জন্য স্থান পায় বাংলার ইলিশ। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার আশপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীতে এ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, একটি মা ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে। এসব ডিমের ৭০-৮০ শতাংশ ফোটে রেণু হয়। এর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে ইলিশে রূপান্তরিত হয়।
ইলিশ কূটনীতি
দুর্গাপূজা সামনে রেখে ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষ করে কলকাতার গণমাধ্যমগুলো। গত সোমবার ২ হাজার ৮০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পর বৃহস্পতিবার আরও ২ হাজার ৫২০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়।
দেশে দাম চড়া
গত কয়েক দিনে ইলিশের সবচেয়ে বড় বাজার চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছবাজারেও আমদানি বেড়েছে ইলিশের। কিন্তু দাম কমেনি। ভারতে রপ্তানির ঘোষণার পর বড় ইলিশের দাম আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব পড়েছে রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারেও।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সবে বরাত সরকার বলেন, কয়েকদিন ধরে এখানকার বাজারে দেড় থেকে দুই হাজার মণ ইলিশের আমদানি হয়েছে। কিন্তু আমদানি বাড়লেও দাম কমেনি। বড় ইলিশের দাম বেড়ে গেছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে সরকার ৫২টি প্রতিষ্ঠানকে ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার খবরে দাম বেড়েছে। এ ছাড়া ৪ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। ফলে এ অল্প সময়ের মধ্যে মাছ সংগ্রহ করছেন রপ্তানিকারকরা। তাই দাম একটু চড়া।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে কিন্তু বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। পাইকারি বাজারের তুলনায় খুচরায় দাম আরও বেশি চড়া। কয়েক হাত বদল হয়ে বিক্রি হওয়ায় দাম এমনটা বেড়ে যাচ্ছে। চাহিদা বেশি থাকায় খুচরা বিক্রেতারা বড় ইলিশের দাম হাঁকছেন ইচ্ছামতো।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে মাঝারি আকারের (এক কেজি ওজনের) ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত। তুলনামূলক ছোট আকারের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। অন্যদিকে বড় ইলিশ (এক কেজির বেশি/দেড় কেজি) ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকা দরে। অথচ পাশেই অবস্থিত যাত্রাবাড়ী বাজারের খুচরা বিক্রেতারা এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি করছেন এক থেকে এক হাজার ১০০ টাকা কেজি দরে এবং এর থেকে একটু কম ওজনের ইলিশ বিক্রি করছেন ৮০০ টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে দেড় কেজি বা এর কাছাকাছি ওজনের ইলিশ বিক্রি করছেন দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত।
যাত্রাবাড়ী বাজারের মাছ বিক্রেতা সিরাজ উদ্দিন বলেন, হাত বদল হলে দামও বেড়ে যায়। তার ওপর পরিবহন খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি বরফের দামও এখন বেড়ে গেছে। ইলিশের পেছনে বরফ খরচ করতে হয় অনেক। সব মিলিয়ে দাম অনেকটা বেড়ে যায়।
তবে যাত্রাবাড়ী পাইকারি বাজারের সততা মৎস্য ভা-ারের ব্যবসায়ী আজম আলী জানান, ভারতে মাছ পাঠানোর খবরে দাম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে এক কেজি ও এর বেশি ওজনের ইলিশের দামই বেড়েছে বেশি। কিন্তু আড়তে কম বাড়লেও খুচরায় দাম অনেক বেশি বেড়েছে। কারওয়ানবাজারের খুচরা বিক্রেতা স্বপনচন্দ্র বলেন, সপ্তাহের ব্যবধানে বড় ইলিশের দাম বেড়েছে। দেড় কেজির কাছাকাছি বড় ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২০০ থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত। এক কেজি ওজনের ইলিশ ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকা এবং একটু ছোট ইলিশ ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।