ডেস্ক নিউজ
ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। এক্ষেত্রে অর্থের বড় জোগান আসছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, গতিশীল অভ্যন্তরীণ বাজার, জাকাত ও ফিতরা থেকে। ঈদের অর্থনীতি নিয়ে সরকারিভাবে কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও বেসরকারি গবেষণা অনুযায়ী এ উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত লেনদেন হয়। এ টাকার বড় অংশই যায় গ্রামে। গত ২৪ এপ্রিল প্রকাশ হওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বল?ছে, চলতি এপ্রিল মাসের ২১ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪০ কো?টি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা) এ অর্থের পরিমাণ ১২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এ হিসাবে রোজায় প্রতিদিন গড়ে ৬০০ কোটি টাকার মতো রেমিট্যান্স দেশে আসছে। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে এপ্রিল মাস শেষে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাধারণত সব সময় ঈদ উৎসব বা বিভিন্ন পার্বণে প্রবাসীরা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও রমজানের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ঈদের আগে রেমিট্যান্স ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদরা জানান, শুধু রেমিট্যান্সই নয়, ঈদকে ঘিরে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষের বোনাস এবং জাকাত-ফিতরার একটি বড় অংশ যায় গ্রামে। এর ধারাবাহিকতায় রোজার শুরু থেকেই গ্রামের হাট-বাজার থেকে শুরু করে সকল স্তরে টাকার প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। এবার ঈদে দীর্ঘ ছুটি থাকায় চাকরিজীবীরা ছুটি কাটাতে গ্রামে যাওয়ায় ভোগব্যয়ের পরিমাণও অনেক বাড়বে। অনেকে তাদের বেতন ভাতার সম্পূর্ণ অর্থ গ্রামে গিয়ে খরচ করবেন। এর ফলে গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি সময়ের সঙ্গে পালস্না দিয়ে চাঙ্গা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে শহুরে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পৌনে ৫ কোটির বেশি। এদের বড় একটি অংশ স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে যাচ্ছেন। এরা বাড়তি খরচের কথা চিন্তা করে গ্রামে যাওয়ার আগে থেকেই সাধ্য অনুযায়ী সঞ্চয় ভেঙে এবং বেতন-বোনাস বাঁচিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যান। এসব টাকা এখন বিভিন্ন প্রয়োজনে গ্রামেই হাতবদল হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, করোনার কারণে দুই বছর ঈদ আনন্দ সেভাবে উদ্যাপিত না হলেও এবার এ উৎসবে অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। মানুষ এই উৎসব ঘিরে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করছেন। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে লাভবান হচ্ছেন। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে। ঈদ উৎসব পালন করতে রোজার শেষ দিকে শহরের অধিকাংশ মানুষ যান গ্রামের বাড়িতে। ফলে গ্রামের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ঈদকে কেন্দ্র করে বিনোদনের জন্য মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামেই বেশি যায়। ফলে গ্রামীণ পর্যটন খাতেও যোগ হয় বাড়তি টাকার প্রবাহ। সার্বিক এই কর্মকান্ডের কারণে সাধারণত অন্য মাসের তুলনায় এ সময়ে অতিরিক্ত অর্থের ব্যয় হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই টাকার প্রভাব বেড়ে যায়। তিনি বলেন, ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় নতুন পোশাক ক্রয়ে। এ সময় অভ্যন্তরীণ পোশাকের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ে। আগে বিদেশি কাপড়ে প্রতি সবার ঝোঁক বেশি থাকলেও এখন গ্রামের লোকজনদেরও পাশাপাশি শহরের মানুষেরও দেশীয় পোশাকের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। গ্রামের মহিলারা এখন অনেক কারুশিল্প তৈরি করেছে। যার ইতিবাচক প্রভাবে ঈদকে সামনে রেখে গ্রামীণ অর্থনীতি দিনে দিনে চাঙ্গা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন পরিচালক বলেন, রমজান ও ঈদের সময় দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি থাকে। এ সময় প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। আর এর বেশির ভাগ অর্থ যাচ্ছে গ্রামে। গ্রামনির্ভর এ দেশের প্রতিটি গ্রামের মহলস্নাতে ৫ থেকে ৭টি এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে, যাদের কোনো না কোনো সদস্য প্রবাসে থাকেন। তারা উৎসবকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স পাঠান সাধারণ সময়ের তুলনায় বেশি। আর ঈদের সময় বেশিরভাগ লোকজন গ্রামে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ কাটাতে যায়। এতে গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা বাড়ে। আর চাহিদা মিটাতে অর্থ ব্যয় হয়। যার ফলশ্রম্নতিতে প্রতিবছর ঈদ এলেই গ্রামীণ অর্থ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গতিশীল হয়ে উঠে। এদিকে ঈদুল ফিতরে শহর-গ্রামের ধনী ও রাজনৈতিক নেতারা দান-খয়রাত ও জাকাত দিতে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় এবং বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য বিতরণ করে। ফলে এই সময়টাতে গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে জোগান এবং দামও। মূলত এই বাড়তি চাহিদা এবং জোগান সক্ষমতাই গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলেছে। তবে অর্থনীতিবিদরা এর নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ারও কিছু পরামর্শ দেন। তাদের মতে, গ্রামীণ অর্থ প্রবাহের একটি বড় অংশই ব্যয় হয় ভোগ-বিলাসে। সামান্য কিছু অংশ যায় গ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্পভিত্তিক উৎপাদন খাতে। এছাড়া যাকাত-ফিতরার বিশাল অংকের টাকা যায় নিম্ন আয়ের মানুষের হাতেও। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এটি ইতিবাচক দিক থাকলেও বাড়তি টাকার প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এজন্য ঈদের পর ওই টাকা উৎপাদন খাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ থাকা জরুরি। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিনের হিসাবে জাকাত ও ফিতরার প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা, তৈরি পোশাকের ৩৫ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্যের বাজার ২৫ হাজার কোটি এবং ঈদ বোনাস, পরিবহণ ও অন্যান্য মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা সরাসরি ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন হয়। এ ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ২৭ হাজার কোটি টাকার কিছু অংশ ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন হয়ে থাকে। যা এ বছর আরও বাড়বে। তিনি বলেন, ঈদ সামনে রেখে চলতি বছর আমাদের দোকানগুলোর বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। আশা করি, এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে বেচাকেনা মোটামুটি ভালো। মাস শেষে পুরোটা বোঝা যাবে। অন্যদিকে এ বছর সাড়ে ১২ লাখ কর্মকর্তা ও কর্মচারী সরকারি বেতন কাঠামোর আলোকে ঈদ বোনাস পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে তিন বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজস্ব কাঠামোতে বোনাস দিচ্ছেন। এছাড়া পোশাক ও বস্ত্র খাতের প্রায় ৮০ লাখ কর্মীও বোনাস পাচ্ছেন। যার একটি বড় অংশ যোগ হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এদিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের বাইরেও জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এবারের ঈদে রাজনৈতিক নেতাদের একটি বড় অংশ গ্রামে নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে বিপুল অংকের যাকাত-ফিতরা দেওয়ার পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের উপহার সামগ্রী বিতরণ করবেন। ঈদ শুভেচ্ছায় তারা কেউ কেউ কোটি টাকায় ব্যয় করবেন। আবার অনেক নতুন মুখ রাজনীতিতে পরিচিত হওয়ার জন্য ঈদ শুভেচ্ছায় অঢেল টাকা ব্যয় করেন। এছাড়া মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গরিব, দুস্থ, এতিমদের পাশে দাঁড়ায় তারা। জাকাতের কাপড় বিতরণের ধুম পড়ে যায়। যার ইতিবাচক প্রভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যার প্রভাব এবার কিছুটা আগেভাগেই পড়তে শুরু করেছে। গ্রামীণ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার কারণে রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই গত দুই বছর গ্রামমুখী হননি। তবে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এবার প্রায় সবাই গ্রামে ছুটে এসেছেন। যারা এখনও গ্রামে পৌঁছাতে পারেননি, তারা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জাকাতের কাপড়-চোপড়, অর্থ ও বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়ে দিয়েছেন। যা রোজার মাঝামাঝি সময় থেকেই এলাকায় বিলি হচ্ছে। আবার কেউ কেউ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিম্নবিত্ত মানুষের তালিকা তৈরি করে রেখেছেন। ঈদের এক দু’দিন আগে গ্রামে ফিরে তারা নিজ হাতে অর্থ কিংবা খাদ্যপণ্য বিলি করবেন। এদিকে গ্রামের বিপুল সংখ্যক কুটিরশিল্পও গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে রোজা শুরুর আগ থেকেই গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় পণ্য উৎপাদনের ধুম পড়ে। শহর-গ্রাম সবখানেই এসবের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির চাহিদা রয়েছে দেশব্যাপী। চাহিদা মেটাতে ওই এলাকায় তাঁত মালিক ও তাঁতিরা ব্যাপক পণ্য উৎপাদন করে। সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের লুঙ্গি ও তাঁতের কাপড় সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিক্রি হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের রুহিতপুরী তাঁতের কাপড়ের চাহিদাও এবার তুঙ্গে। গাজীপুরের কালীগঞ্জের টাওয়ালের চাহিদাও বর্তমান বাজারে ব্যাপক। নরসিংদীর বাবুর হাটে ক্রেতার চাপ সামলাতে এবার জেলা প্রশাসন থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। রোজার শুরু থেকে একই অবস্থা ছিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁতের পাইকারি বাজারেও। ঈদকে সামনে রেখে রূপগঞ্জের রূপসীর জামদানি শাড়ি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও গেছে। তাঁতের তৈরি কাপড়ের চাহিদা বাড়ায় ঢাকাকেন্দ্রিক ফ্যাশন হাউস ও বস্ত্র ব্যবসায়ীরা এবার তাঁতিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ কাপড় সংগ্রহ করেছে। সব মিলিয়ে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলোর জমজমাট ব্যবসা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে।