ডেস্ক নিউজ
উদ্বোধনের পর থেকেই পদ্মা সেতু দেশের মানুষের অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা পদ্মা পর্যটনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ঈদের দিন থেকেই প্রতিদিন পদ্মা সেতুর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত এবং মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে মানুষের ঢল নামছে। দুপুরের পর থেকেই এই ঢল বাড়তে থাকে এবং রাতে সেতু এলাকা পর্যটকদের ভিড়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে, সংযোগ সড়কের পাশে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। যারা এক সময় ফেরিঘাটে দোকান দিয়ে পণ্য বিক্রি করতেন তারা এখন টোল প্লাজার সামনে ও সংযোগ সড়কের পাশে নতুন করে দোকান দিয়েছেন। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে সেখানে গ্রামীণমেলার আমেজ তৈরি হচ্ছে। অনেক পর্যটক শিমুলিয়া ঘাটে এসে ট্রলার ও স্পিড বোটে করে সেতুর কাছাকাছি গিয়ে সেতু দেখে আসছে। একই সঙ্গে তাদের নৌভ্রমণও হচ্ছে আবার পদ্মা সেতু দর্শনও হচ্ছে। ফলে পদ্মার পর্যটন বেশ জমে উঠেছে।
পদ্মা সেতু পর্যটকদের জন্য নতুন বিনোদনের স্থানেও পরিণত হয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতি দিন শত শত পর্যটক আসছে পদ্মা সেতু দেখতে। ফলে পদ্মা সেতুর দুপ্রান্ত সবসময় পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকছে। পর্যটনের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে দর্শনে পর্যটকদের জন্য ৯৯৯ টাকার একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজের আওতায় ৫ ঘণ্টায় পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে ঘুরিয়ে আনবে পর্যটন কর্পোরেশন।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলেন, পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে। তার পাশে ইলিশের ভাস্কর্য ও ফোয়ারা আছে। মানুষ এসব স্থাপনা দেখছেন। এসব স্থানকে পেছনে রেখে ছবি এবং সেলফি তুলছেন।
পর্যটন কর্পোরেশনের প্যাকেজ ॥ মাত্র ৯৯৯ টাকায় পদ্মা সেতু ও ভাঙ্গা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ঘুরাবে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। গত ১২ জুলাই এই প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সংস্থাটি।
পর্যটন কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা জিয়াউল হক হাওলাদার বলেন, স্বাভাবিক রেটের চেয়ে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও নান্দনিক ভাঙ্গা চত্বরে পর্যটনের আধুনিক এসি ট্যুরিস্ট কোস্টারে ট্যুর হবে ২২ জুলাই শুক্রবার।
আগ্রহীদের আগে প্যাকেজ বুকিং করে ২২ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টায় আগারগাঁওয়ের পর্যটন ভবনের নিচতলায় আসতে হবে। পৌনে ৪টায় আসন গ্রহণ ও ৪টায় ভ্রমণ শুরু করা হবে। দিনের আলোয় পদ্মা সেতু ও ভাঙ্গা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে নান্দনিক ভাঙ্গা চত্বরে উপস্থিত হওয়ার পর সেখানে বৈকালিক স্ন্যাক্স দেয়া হবে। সন্ধ্যা ৭টায় আলোকসজ্জিত পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় ফিরে আসা হবে। ট্যুর সমাপ্ত হবে রাত ৯টায়।
পর্যটন কর্পোরেশন জানায়, আগ্রহীরা ০১৯৪১৬৬৬৪৪৪ নম্বরে ফোন দিলে বিকাশ নম্বর দেয়া হবে। অথবা পর্যটন ভবনেও ভ্রমণ মূল্য পরিশোধ করা যাবে। আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে বুকিং নেয়া হবে।
জাজিরা প্রান্ত ॥ পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজা নাওডোবায়। পদ্মা সেতুর সাড়ে ১০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে শিবচরের পাচ্চর পর্যন্ত। এরপর ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে। দিনভর ওইসব স্থানে ঘুরে সন্ধ্যায় লোকজন টোল প্লাজার সামনে আসছেন। ঢাকামুখী দর্শনার্থীরা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করছেন।
শতাধিক ব্যবসায়ী টোল প্লাজার পাশে সংযোগ সড়ক ঘেঁষে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়েছেন। খাবারের দোকান, শিশুদের খেলনার দোকান ছাড়াও বিভিন্ন জিনিস নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। পর্যটকদের পদচারণায় এসব দোকানের বিক্রিও অনেক বেড়ে গেছে। ফলে পদ্মার পর্যটন নতুন নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি করছে।
ঢাকা থেকে প্রচুর পর্যটক যাচ্ছেন পদ্মা সেতু দেখতে। নিজস্ব প্রাইভেটকারে পরিবার পরিজন নিয়ে যাচ্ছেন পদ্মা সেতু দেখতে। তারা ঢাকায় ফিরে যাওয়ার সময় রাতে জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে সময় কাটাচ্ছেন। দিনের আলোয় পদ্মা পাড়ি দিয়ে আবার রাতের আলো পদ্মা সেতুর অপূর্ব সৌন্দর্য অবলোকন করে ঢাকায় ফিরছেন।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলীরা জানান, ২৫ জুনের পর থেকে দর্শনার্থীরা দিনে পদ্মা সেতু দেখতে আসছেন। ঈদের দিন থেকে দিনের পাশাপাশি গভীর রাত পর্যন্ত জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার আশপাশে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু দেখতে এসে ভাঙ্গা বিশ্বরোড এলাকায়ও দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় জমছে। পদ্মা সেতু পার হওয়ার পর মোড়ে মোড়ে হাজারও মানুষের ঢল চোখে পড়ছে। ভাঙ্গার অন্যতম সৌন্দর্যে ভরা গোলচত্বরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ঢল নামছে ঈদের দিন থেকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্মা সেতু পার হওয়ার পর কাঁঠালবাড়ি ঘাটে পর্যটকদের ভিড় জমে উঠেছে। সেখানে পর্যটকরা নিজেরা রান্নাবান্না, পদ্মা নদীতে গোসল করাসহ আনন্দে দিন কাটাচ্ছেন। তারা মনে করেন, পদ্মা সেতু দেখেছি, এর পর নদীতে গোসল করে মনে হয়েছে কক্সবাজারে এসেছি। দিন পার হচ্ছে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে। পদ্মা সেতু পার হওয়ার পর থেকে মোড়ে মোড়ে বেশ কিছু দোকানপাট, একটা শিশুপার্ক এবং ভাসমান হোটেল গড়ে উঠেছে।
ভাঙ্গা ফ্যামিলি ড্রিম পার্কের ম্যানেজার নাজমুল ইসলাম জানান, ভাঙ্গায় আনন্দ-বিনোদনের জন্য সরকারী বা বেসরকারীভাবে কোন পার্ক ছিল না। আমরা ভাঙ্গার গোলচত্বর মোড়ের ছোট পরিসরে শিশুসহ সব বয়সের মানুষকে বিনোদনের জন্য একটি পার্ক নির্মাণ করছি।
তিনি বলেন, সোমবার সকালে পার্কটি চালুর পর থেকে এলাকাসহ ঢাকা থেকে সব বয়সের মানুষের উপচেপড়া ভিড় জমে উঠছে। বেশ ভাল টাকা আয় হচ্ছে। এই পার্কটি দিন দিন মানুষের আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মাওয়া প্রান্ত ॥ একই অবস্থা পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে। ঈদের ছুটিতে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখতে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। ঈদের পরদিন বিকেল থেকে দূর-দূরান্ত হতে বন্ধু ও পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসছেন অনেকে। বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে নদী তীরজুড়ে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা হৃদয় হাসান বলেন, ‘পাঁচ বন্ধু মিলে নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী আসি। এরপর যাত্রাবাড়ী থেকে বাসে করে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে এসেছি। আসলে এই সেতু আমাদের গর্বের জিনিস। পদ্মা সেতু দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ঢাকা পার হতেই বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের সড়ক দেখে আমরা মুগ্ধ।’
অনেক পর্যটক শিমুলিয়া ঘাটে এসে ১৫০০ টাকা দিয়ে ট্রলার ভাড়া করে সেতুর কাছাকাছি গিয়ে সেতু দেখে আসছে। অনেক পর্যটক স্পিড বোটে করেও কাছাকাছি গিয়ে পদ্মা সেতু দেখছে।
মুন্সীগঞ্জ সদর থেকে আসা ইসমাইল তালুকদার সামি বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। এই সেতু ঘিরে আমাদের অনেক আশা এখন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ট্রলারে করে সেতুর কাছাকাছি ঘুরে বেড়ালাম। যদি সেতুর উপরে উঠতে পারতাম তাহলে আরও ভাল লাগত।’
ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই মানুষের ভিড় নামে পর্যটন এলাকায়। এবার সেই ঈদকে ঘিরে পর্যটনের সব সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে পদ্মা সেতু। পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘ পথ কম সময়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা হওয়ায় এবার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অগ্রিম শতভাগ হোটেল মোটেল বুকিং হয়ে গেছে কুয়াকাটায়। কুয়াকাটা ছাড়াও এই অঞ্চলের পর্যটন এলাকা ঘিরে আকর্ষণীয় প্যাকেজও ঘোষণা করছে ট্যুর অপারেটররা।
জানা যায়, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন এলাকায় মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ঘিরে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে পর্যটকরা। আগে যেখানে ঢাকা থেকে দক্ষিণের সাগরকন্যা কুয়াকাটায় যেতে সময় লাগত ১০ ঘণ্টা। পার হতে হতো অনেক ফেরি। পদ্মা সেতু হওয়ায় সেখানে যেতে সময় লাগছে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা। যার কারণে এবার ঈদে ব্যাপক সাড়া মিলেছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। কুয়াকাটায় হোটেল-মোটেল সব মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ১৫০টি। এসব হোটেল-মোটেল এবার ঈদে ছিল পর্যটকে ঠাসা। এবার প্রায় ৮০ হাজার পর্যটক ঈদের পর দিন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত কুয়াকাটা ভ্রমণ করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ট্যুর অপারেটরস এ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা (টোয়াক) সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি আমূল পরিবর্তন এসেছে। যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তারা এবার তাদের নিজেদের গাড়ি নিয়ে কুয়াকাটা এসেছেন। তিনি জানান, কুয়াকাটায় হোটেল-মোটেলে রাত্রি যাপন করতে পারছেন ১০-১৫ হাজার মানুষ। এছাড়া আশপাশে আরও কিছু ঘর আছে সেখানেও প্রায় ৩ হাজার মানুষ থাকতে পারছে। এছাড়া অনেক পর্যটক দিনে এসে আবার চলে গেছে।