ডেস্ক নিউজ
নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার শিতল ডাঙ্গা গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ (৭০) বলেন, ১৯৮৫ সালের আগে আমাদের এলাকায় বছরে একটি ফসল হতো। একরে ১৫-২০ মণ ধান উৎপাদন হতো। সেটাও বৃষ্টির পানিতে। যেবার সময় মতো বৃষ্টি হতো না, সেবার কোনো ফসলে ঘরে আসত না। এখন একরে ৮০-৯০ মণ পর্যন্ত ধান উৎপাদন হচ্ছে। কিছু কিছু জমিতে তিনটির বেশি ফসল হয়। আর এসব হচ্ছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) স্থাপিত গভীর নলকূপের পানি দিয়েই। ১৯৯০ সালের আগের মরুর মতো ঠা-ঠা বরেন্দ্র এলাকা এখন সবুজে পরিণত হয়েছে বিএমডিএ’র কারণে।
উপজেলার রামরামপুর গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম (৫৫) বলেন, বর্তমানে সাপাহারে শত শত হেক্টর এলাকাজুড়ে আমের চাষ হয়। এটাকে সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রাখছে বিএমডিএ’র পানির মাধ্যমে। সঠিক সেচ ব্যবস্থা থাকায় আম পুষ্ট ও সুমিষ্ট হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হচ্ছে সাপাহারের আম। এই সাফল্যের দাবিদার কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় ও বিএমডিএ।
বিএমডিএ’র সাপাহার জোনের সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, উপজেলায় ৩২৩টি নলকূপসহ, এলএলপি, সৌরশক্তি চালিত এলএলপি, খাস মজা খাল পুনঃখনন, খাবার পানি সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাংক নির্মাণ, বনায়নসহ পানির সঠিক ব্যবহারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বিএমডিএ।
বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রশিদ জানান, বরেন্দ্র এলাকার কৃষি, কৃষি পরিবেশ এবং সেচ অবকাঠামো উন্নয়নসহ সেচ এলাকা ও আবাদি জমি সম্প্রসারণ, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও বিপণন এবং পরিবেশ উন্নয়নে ফলদসহ অন্যান্য বৃক্ষ রোপণে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। বরেন্দ্র এলাকাকে দেশের শস্যভান্ডারে রূপান্তর এবং মরুময়তা রোধকল্পে বনায়ন ও সম্পূরক সেচের জন্য খাল-দীঘি পুনঃখনন ছাড়াও গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে পণ্য বাজারজাতকরণ এবং জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করছে বিএমডিএ।
কর্তৃপক্ষ সেচে ভূ-উপরিস্থ ১
ও ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের উন্নয়ন ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করছে।
বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৮৫ সালের পূর্বে লাল কংকরময় মাটির উঁচু-নিচু টিলা, ছায়াহীন এক রুক্ষ প্রান্তর ছিল বরেন্দ্র অঞ্চল। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, প্রাচীনকালে বরেন্দ্র ভূমির চিত্র ভিন্ন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে শুরু করে বৌদ্ধ ধর্ম ও কৃষ্টির প্রসারকালে এই অঞ্চল কৃষি ও শিল্প-সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশও সে সময় বেশ চমৎকার ছিল। ইতিহাসবিদ নেলসনের (১৯২৩) মতে, বরেন্দ্র অঞ্চল জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। উইলিয়াম হান্টারের (১৮৭৬) বর্ণনা মতে, বাংলার প্রায় সব ধরনের গাছই এই অঞ্চলে পাওয়া যেত। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলের সময় লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি জমির সম্প্রসারণ, বসতবাড়ি স্থাপন, শিল্পে কাঁচামালের জোগান, আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণ সামগ্রী, জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যাপক ব্যবহার, রাস্তা, বাঁধ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণের কারণে তিল তিল করে ধ্বংস হয়েছে অত্র এলাকার বনভূমি। মূলত ওই সময় থেকেই এই অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পরিবেশের স্বাভাবিক নিয়মে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। এ ছাড়াও পলি জমে অধিকাংশ নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হয়ে পর্যাপ্ত পানি ধারণ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। ফলে এই অঞ্চলে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎসও খুবই অপ্রতুল হয়ে পড়ে। যথাসময় বৃষ্টিপাত না হলে এই অঞ্চলে ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হতো। ঠিকভাবে ফসল উৎপাদন না হওয়ায় এই এলাকার জনসাধারণ অত্যন্ত দরিদ্র ছিল।
মাটির গঠন এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের স্বল্পতার কারণে এই অঞ্চলে প্রচলিত গভীর নলকূপ দ্বারা সেচ কাজ সম্ভব ছিল না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সালে এই অঞ্চলের তৎকালীন বিএডিসির প্রকৌশলীরা এক বিশেষ ধরনের গভীর নলকূপ উদ্ভাবন করে ভূ-গর্ভস্থ পানি দ্বারা সেচের সুযোগ সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) আওতায় ‘বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের (ইওঅউচ)’ মাধ্যমে এই অঞ্চলে উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ১৫টি উপজেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। গভীর নলকূপ স্থাপন ও পুকুর-খাল খননের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সৃষ্টি করা, বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে মরুপ্রক্রিয়া রোধ করা এবং উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করা ও যাতায়াতের জন্য ফিডার রোড নির্মাণ করা ছিল এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
সময়ের স্বল্পতা, অর্থায়নের প্রতিকূলতাসহ নানাবিধ প্রশাসনিক জটিলতায় প্রকল্পের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, কিন্তু অল্পসংখ্যক হলেও উলেস্নখিত কার্যক্রম এই এলাকার মানুষের মনে বিরাট আশার আলো জাগায়। বরেন্দ্র এলাকার বিরান ভূমিতে সোনালী ফসলের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পরে সমগ্র বরেন্দ্র এলাকার উন্নয়নের জন্য ১৯৯২ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সব (২৫টি) উপজেলাকে অন্তত্মর্ভুক্ত করে ‘বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)’ নামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়।
মনিটরিং বিভাগ থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালে জারিকৃত ‘বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৮’ এর মাধ্যমে বর্তমানে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলাকেই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধিক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উক্ত আইন অনুসারে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালককে সদস্য সচিব করে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালনা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়াও আইন মোতাবেক কৃষিমন্ত্রীকে সভাপতি করে প্রতিমন্ত্রী, বরেন্দ্র এলাকার সব সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিএডিসি, বিএমডিএ এবং বিএআরসির চেয়ারম্যান, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার, কৃষি-সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, নির্বাহী প্রধান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছে।
এ ছাড়া এক হাজার ৮৯৪ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। যাদের মধ্যে ১৯৪ জন সহকারী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী রয়েছেন। এসব নিয়ে এগিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইতোমধ্যে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৬ জেলায় ১৫ হাজার ৭৯৩টি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। ১৩৫০১ কি. মি. এলাকায় সেচের পানি বিতরণ ব্যবস্থা নির্মাণ করেছে। ৫৩২টি এলএলপি, ১১৯টি সৌরশক্তি চালিত এলএলপি, ১১টি নদীতে পন্টুন স্থাপন করেছে। ২০২৪ কি. মি. খাস মজা খাল, ৩১৪০টি খাস মজা পুকুর পুনঃখনন করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ৭৪৯টি ক্রসড্যাম এবং ৫৭২টি সোলার ডাগওয়েল। নওগাঁ জেলার রক্তদহ বিল, টেপাবিল, মনছুর বিল এবং রাজশাহী জেলার ছত্রগাছা বিল, দেবর বিল ইত্যাদিসহ ১০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জলাবদ্ধতা নিরসন করা হয়েছে। এক হাজার ১৪৪ কি. মি. সংযোগ রাস্তা নির্মাণ করেছে। এক হাজার ৫৭৯টি পরিবারের খাবার পানি সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। বনায়নের লক্ষ্যে দুই কোটি ৫৮ লাখ বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। প্রতিবছর উৎপাদন করা হচ্ছে ৬০০ মে. টন বীজ। এক লাখ ৪৮ হাজার ২১৮ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প রয়েছে আরও আটটি।
সব মিলিয়ে বরেন্দ্র এলাকার মানুষের জীবন মান উন্নয়নে বিএমডিএ’র কর্মসূচিগুলো আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৯.৮৯ লাখ কৃষক পরিবার উপকৃত হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। বিএমডিএ’র বদৌলতে এক সময়ের ধু-ধু প্রান্তরের বরেন্দ্র ভূমির বুকজুড়ে আজ চোখে পড়ছে দিগন্তজোড়া ফল ও ফসলের মাঠ।