ডেস্ক নিউজ
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় শিল্পের বিকাশে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের করে বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে। করপোরেট কর কমানো হয়েছে আড়াই শতাংশ। কয়েকটি খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিছু খাতে বাড়ানো হয়েছে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ। এছাড়া শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির শুল্ক কমানো হয়েছে। কিছু খাতে কমানো হয়েছে আগাম কর। ফলে দেশীয় শিল্প বাড়তি সুবিধা পাবে। শিল্পের খরচ কমায় বাড়বে বিনিয়োগ।
দেশে মেগা শিল্পের বিকাশ এবং আমদানির বিকল্প শিল্পোৎপাদনকে ত্বরান্বিত করার স্বার্থে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশে বাজেটে অটোমোবাইল-থ্রি হুইলার এবং ফোর হুইলার উৎপাদনকারী কোম্পানিকে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন কিছু শর্ত সাপেক্ষে আরও ১০ বছর কর অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
কতিপয় হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সেস পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল শিল্পের পণ্যের উৎপাদনকারী কোম্পানিকে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছর মেয়াদি কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
এর বাইরে আগামী অর্থবছরে করপোরেট কর ৩০ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরে সাড়ে ৩২ শতাংশ। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ এবং একক ব্যক্তি কোম্পানির করহার সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশের প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যক্তি করদাতাদের ব্যবসায়িক টার্নওভার করহার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
কৃষিভিত্তিক শিল্পে বেশ কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। শর্ত সাপেক্ষে দেশে উৎপাদিত সব ধরনের ফল শাক-সবজি প্রসেসিং শিল্প, দুধ ও দুগ্ধজাতপণ্য উৎপাদন, সম্পূর্ণ দেশীয় কৃষি থেকে শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী শিল্প এবং কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী শিল্পের জন্য ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব করা হয়েছে। সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে করহার ৩ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ এবং সিমেন্ট, লৌহ ও লৌহজাতীয় পণ্য সরবরাহের বিপরীতে উৎসে কর কর্তন ৩ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া দেশে শিল্পায়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশ কিছু খাতের কর্মীদের পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদানে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।
আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে হোম অ্যাপ্লায়েন্স সামগ্রী এবং তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। এয়ারকন্ডিশনে ২০২৪ সাল ও রেফ্রিজারেটরে ২০২২ সাল পর্যন্ত উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
কৃষি আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ইলেকট্রনিক্স শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এখন দেশেই বিশ্বমানের এয়ারকন্ডিশন ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদন হচ্ছে। এমনকি বিদেশি ব্রান্ডও দেশে কারখানা স্থাপন করেছে এবং অনেক ব্র্যান্ড পরিকল্পনা করছে। এ দুই খাতে বিপুল বিনিয়োগের কারণে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। তাই করোনা পরিস্থিতিতে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, হোম অ্যাপ্লায়েন্সসামগ্রী উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আগামী দুই বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেসার কুকার দেশে উৎপাদন করলে উপকরণ-যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট দেওয়া লাগবে না।
এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিকাশে প্রিন্টার, টোনার কার্টিজ, ইনকজেট কার্টিজ, কম্পিউটার প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এআইও, ডেস্কটপ, নোটবুক, নোটপ্যাড, ট্যাব, সার্ভার, কিবোর্ড, মাউস, বারকোড ও কিউআর কোড স্ক্যানার, পিসিবিএ/মাদারবোর্ড, পাওয়ার ব্যাংক, রাউটার, নেটওয়ার্ক সুইচ, মডেম, নেটওয়ার্ক ডিভাইস/হাব, স্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম, ইয়ারফোন, হেডফোন, এসএসডি/পোর্টেবল এসএসডি, হার্ডডিস্ক ড্রাইভ, পেনড্রাইভ, মাইক্রো এসডি কার্ড, ফ্ল্যাশ মেমোরি কার্ড, সিসিটিভি, মনিটর, প্রজেক্টর, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড, ই-রাইটিং প্যাড, ইউএসবি ক্যাবল, ডিজিটাল ঘড়ি, বিভিন্ন প্রকাশ লোডেড পিসিবি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
পাশাপাশি ১৬শ সিসি পর্যন্ত গাড়ি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে যন্ত্রাংশ আমদানিতে আগাম কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে সেটিও বাতিল করা হচ্ছে। এছাড়া পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, মোবাইল ফোন এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।
শুধু ভারী শিল্প বা আইটি শিল্প নয়, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকেও বাজটে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে শর্তসাপেক্ষে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে প্রস্তুতকৃত যন্ত্রাংশ সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শর্ত হচ্ছে, দেশীর ভারী শিল্পকে যেসব যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট ও শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেসব যন্ত্রাংশ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাত উৎপাদনের পর তা সরবরাহ করলে ভ্যাট দিতে হবে না। অবশ্য এ জন্য প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধিত হতে হবে এবং রিটার্ন জমা দিতে হবে।
এছাড়াও কৃষি আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে থ্রেসার মেশিন, পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার, অপারেটেড সিডার, কম্বাইন হারভেস্টর, রোটারি টিলার, উইডার (নিড়ানি) ও উইনোয়ার (ঝাড়াইকল)। পাশাপাশি স্ক্র্যাপ ভেসেল; স্টিল শিল্পের ওয়েস্ট ও স্ক্র্যাপ, ফেরো অ্যালয়, স্পঞ্জ আয়রন; পিভিসি ও পেট রেজিন উৎপাদনে ব্যবহৃত ইথাইলিন গ্লাইকল, টেরেফথালিক অ্যাসিড, ইথাইলিন/প্রোপাইলিন আমদানি এবং উপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাজু বাদাম আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার হয়েছে।
বিদ্যমান ভ্যাট আইনটি আরও ব্যবসাবান্ধব ও যুগোপযোগী করতে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম করহার কমানো হয়েছে। ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ দুটোতেই ছাড় দেওয়া হয়েছে। আগাম কর হার ৪ শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমানে ভ্যাট ফাঁকির ক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ভ্যাট ফাঁকির সমপরিমাণ জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। এছাড়া সময়মতো ভ্যাট না দিলে ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সরল সুদে জরিমানার বিধান রয়েছে। এটি বাজেটে এক শতাংশ করা হচ্ছে।