- মেগা বিদ্যুত প্রকল্প, বন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে
- ব্যাপক কর্মসংস্থানে সমৃদ্ধ হবে অর্থনীতি বন্দর ঘিরে আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে রূপ নেবে
পায়রা, মহেশখালী এবং রূপপুর তিন জ্বালানি হাব বাস্তবায়নে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতির চালচিত্র। এ জন্য দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে মেগা বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে দুটি সমুদ্র বন্দর এবং ছয়টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সঙ্গে রফতানি বাণিজ্যে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হবে। আশা করা হচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ -পশ্চিম আর উত্তরাঞ্চলে শিল্পায়নের নবদিগন্ত উন্মেচিত হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে তিন মেগা বিদ্যুত প্রকল্পের কাজ। একই সঙ্গে বিদ্যুত উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানির সংস্থানে নির্মাণ করা হয়েছে এলএনজি টার্মিনাল। সহজে কয়লা আমদানির জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে।
বিদ্যুত বিভাগ বলছে, বিদ্যুত হাবের মধ্যে সব থেকে এগিয়ে রয়েছে পায়রা। এখানে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুত কেন্দ্র ইতোমধ্যে উৎপাদনে এসেছে। আগামী মাসের যে কোন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খচিয়াং কেন্দ্রটি উদ্বোধন করবেন। কেন্দ্রটি উদ্বোধনের জন্য নবেম্বরে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল)।
বিসিপিসিএল সূত্র বলছে, এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের পাশাপাশি এখানে একই ক্ষমতার আরও একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে তারা। বিসিপিসিএল এর পাশাপাশি চীনের নরিনকো পাওয়ারের সঙ্গে যৌথভাবে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
উৎপাদিত বিদ্যুত ব্যবহার করে পায়রায় ব্যাপক শিল্পায়নের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এজন্য পায়রা বন্দর নির্মাণ করছে সরকার। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে এ জন্য তারা ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এই জমিতে বন্দরের অবকাঠামোর পাশাপাশি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশাপাশি এলএনজি টার্মিনাল, সার কারখানা নির্মাণ করার চিন্তা করা হচ্ছে। এখন দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগ সারই আমদানি করা হচ্ছে। এখানে এলএনজি আনা সম্ভব হলে তা দিয়ে সার উৎপাদন করা সম্ভব হবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের কৃষি জমিতে এসব সার ব্যবহার করা সহজ হবে।
ইতোমধ্যে সীমিত পরিসরে বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এখন বন্দর চ্যানেলের ড্রেজিং করা হচ্ছে। এই ড্রেজিংয়ের ফলে চ্যানেলের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে এলএনজি আমদানি করা সহজ হবে। পেট্রোবাংলার তরফ থেকে এখানে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বলা হচ্ছে, একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার বা ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এখানে আরও দুটি কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে সব মিলিয়ে ব্যয় হতে পারে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। পায়রা বন্দরে এখন পর্যন্ত নির্মাণ এবং অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে তিন হাজার ৯৮২ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তবে এখানে এলএনজি টার্মিনাল, ব্যাপক শিল্পায়ন হলে এই ব্যয় আরও অনেকটা বাড়বে। একই সঙ্গে বন্দরের সঙ্গে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা আলোচনা হচ্ছে।
একইভাবে কক্সবাজারের মহেশখালীতে লেগেছে বদলের ঢেউ। একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক সমীক্ষায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলার পর এখন তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিদ্যুত এবং জ¦ালানি বিভাগের সঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে নানামুখী উন্নয়ন পরিকল্পনায় জেলে আর নুন চাষীদের উপজেলা মহেশখালী এখন দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুরে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
এখন কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (সিপিজিসিবিএল) মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। প্রকল্পের আওতায় আমদানিকৃত কয়লা লোড-আনলোড জেটি, টাউনশিপ নির্মাণ, স্থানীয় এলাকায় বিদ্যুতায়ন, বিদ্যুত সঞ্চালন লাইন নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হচ্ছে।
এজন্য বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, টাউনশিপ এবং এবং ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর বাইরে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর বাইরে এখানে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র, স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল এবং ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া মহেশখালীতে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করতে চায় রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
মহেশখালীতে রয়েছে বেজার পাঁচ অর্থনৈতিক জোন। এরমধ্যে এক হাজার ৭৮৪ একর জমির ওপর কক্সবাজার ফ্রি ট্রেড জোন, এক হাজার ৪৩৮ একর জমির ওপর মহেশখালী অর্থনৈতিক জোন-১ , অর্থনৈতিক জোন-২ নির্মাণ করা হচ্ছে ৮২৬ একর জমির ওপর অর্থনৈতিক জোন-৩ নির্মাণ করা হচ্ছে ৬৭০ একর জমির ওপর। এছাড়া এখানে আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া বিদ্যুত কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পিডিবি ৫ হাজার ৬৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এর পশাপাশি ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি) এক ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে এক হাজার ৫৬৯ একর জমি অধিগ্রহণ করছে। আর এখন কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির যে বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে এর জন্য এক হাজার ৬০৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
তবে এর অনেক প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় এখনও ঠিক হয়নি। ভবিষ্যতে জমির সংস্থান করতেই এসব জমি অধিগ্রহণ করে রাখা হয়েছে। কোন কোন কেন্দ্রের জন্য আবার সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং চুক্তিও করেছে সরকার। তবে এখানে নির্মাণাধীন ১২০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে উৎপাদনে আসবে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ী ও ধলঘাট এলাকায় বন্দরটি নির্মাণ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করবে। মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ী বন্দরের অংশ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সড়ক অংশ বাস্তবায়ন করবে। সম্প্রতি বন্দর নির্মাণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরিকল্পনা বলছে ২০২৬ সালের মধ্যে বন্দর নির্মাণের প্রথম ধাপের কাজ শেষ হলে ১৮ দশমিক পাঁচ মিটার ড্রাফট এর জাহাজ ভিড়তে পারবে বন্দর জেটিতে। সিঙ্গাপুর বন্দরের ড্রাফট সর্বোচ্চ ১৬ মিটার। অর্থাৎ সিঙ্গাপুরের বন্দর থেকে এই বন্দরের ড্রাফট বেশি। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশ সিঙ্গাপুর বন্দর ব্যবহার করেন তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসবে মাতারবাড়ী।
বাংলাদেশের সমৃদ্ধির আরেক নাম রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্র। শুধু নিউক্লিয়ার ক্লাবেই প্রবেশ নয় কেন্দ্রটি বিশ্বে বাংলাদেশকে অন্যভাবে পরিচিত করিয়েছে। রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্রে দেশে অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়াতে নির্মিত হচ্ছে এর যন্ত্রাংশ। ইতোমধ্যে বড় যন্ত্রাংশের চালান রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ যা বাংলাদেশে এসে পৌঁছবে। এক লাখ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি এককভাবে এ যাবতকাল গৃহীত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সব থেকে বড়। বিদ্যুত কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গত রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে ২০২৪ সালে। সব মিলিয়ে এখান থেকে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাবে। এটি হবে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র। জ্বালানির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। কেন্দ্রটি একটানা ভালভাবে ৫০ বছর বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারবে। আর এটি সংস্কার করে আরও ৩০ বছর চালানো যাবে। এ ধরনের একটি কেন্দ্র স্থাপন করলে ৮০ বছর সেখান থেকে বিদ্যুত পাওয়া সম্ভব। যেখানে অন্য জ্বালানির বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ ২৫ বছর বিদ্যুত পাওয়া যায়। শুরুতে কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদন পরিকল্পনায় পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন লাভজনক বলে বিবেচনা করা হয়।
রাশিয়ার আর্থিক সহায়তায় কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এজন্য প্রকল্পের এক লাখ কোটি টাকার মধ্যে রাশিয়া ৯০ ভাগ বিনিয়োগ করেছে। দেশের বিনিয়োগ ১০ ভাগ।