ডেস্ক নিউজ
সদ্য বিজয়ী দেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭২ সালে লন্ডনে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, হতদরিদ্র দেশে ফিরে আপনি কী করবেন? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার দেশের মানুষ বেঁচে থাকলে আমরা ঠিক আবার জেগে উঠব। ফিনিক্স পাখির মতন জেগে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বারবার ধ্বংসস্ত‚প থেকে জেগে ওঠেছে বিজয়ের বাংলাদেশ। মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিল, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি। বিশ্বে ভিক্ষুকের দেশ হবে বাংলাদেশ। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে; আর কিসিঞ্জারের বক্তব্য অসাড় প্রমাণ করে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। কোভিডে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল। পঞ্চাশ বছরে বদলে যাওয়া নতুন এক বাংলাদেশ দেখছে বিশ্ব। টার্গেট রূপকল্প-২০৪১। এর মধ্যেই উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে জাতি।
গবেষকদের মতে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের যাত্রা ছিল কণ্টকাকীর্ণ পথে। ভৌত-অবকাঠামো, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-যানবাহন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন সব কিছুই ছিল ক্ষতবিক্ষত। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারশূন্য। সহায়-সম্বলহীন, নিঃস্ব কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ঘরে ঘরে ক্ষুধার্ত মানুষ, বাইরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্নীতিসহ আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড় করা, সংবিধান তৈরি, পররাষ্ট্রনীতি তৈরি, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়, আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ, সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান- সবই সামলাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। মাত্র সাড়ে তিন বছরে রাষ্ট্রের কাঠামো তৈরিই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বড় সাফল্য। আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও তাঁর দেখানো পথে হেঁটে বর্তমানে উন্নয়নের রোল মডেল আজকের বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ভোরের কাগজকে বলেন, বিশে^র অনেক উন্নত দেশ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খেয়েছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষভাবে ভাইরাস মোকাবিলা করেছেন। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশের এই বিজয় অর্জন অনন্য।
গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রা : বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে বারবার আঘাত এসেছে গণতন্ত্রের ওপর, আঘাত এসেছে রাজনীতির ওপর। স্বাধীনতা অর্জনের চার বছরের মাথায় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে প্রথম আঘাতটা হানে পরাজিত শক্তি। জেলখানার ভেতরে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। এরপর ক্যু-পাল্টা ক্যু’র রক্তাক্ত অধ্যায়। রাজনীতি যায় নির্বাসনে। জিয়া-এরশাদের স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ বাঙালি রক্ত দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ফিরলেও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির আঁচড় পড়ে লাল-সবুজের পতাকায়। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ২০০৮ সালে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়।
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, শুধু অর্থনৈতিক মুক্তিই নয়; স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল আকাক্সক্ষা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে উন্নয়ন সীমাবদ্ধ নয়। সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও আগামী দিনের রাজনীতির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার স্বীকৃতি : পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ আর জিডিপি বেড়েছে ৩০ গুণ। স্বাধীনতার আগে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৮৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী, বর্তমানে এই সংখ্যা ২০ শতাংশের কম। বিগত প্রায় ৫০ বছরে ধান-চালের উৎপাদন প্রায় চারগুণ হয়েছে। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ থেকে ৪ শতাংশ। বর্তমানে ৮ শতাংশের ওপর। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৬০ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে তৈরি পোশাক ছাড়াও রুপালি ইলিশ, হিমায়িত চিংড়ি, রাজশাহীর ফজলি আম, সিলেটের শীতলপাটি, নারায়ণগঞ্জের জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁত, কুমিল্লার খাদি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের ওষুধ যাচ্ছে বিশে^র ১৬৬টি দেশে। এসব অগ্রগতির স্বীকৃতিও মিলছে। লন্ডনভিত্তিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চ ভবিষ্যতের যে ১০টি উদীয়মান বাজারকে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশে^র ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস এন্ড বিজনেস রিসার্চের ওয়ার্ল্ড লিগ টেবিল ২০২১ রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশে^র ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ।
মেগা প্রকল্পে গতি : করোনার ধাক্কা কাটিয়ে মেগা প্রকল্পগুলোর কাজে এসেছে পূর্ণগতি। চলতি বছরে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের লক্ষ্যে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব সরকারের। আগামী বিজয় দিবসের আগেই পদ্মা সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্য চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া মেট্রোরেল চালু হবে আগামী ডিসেম্বরে। কর্ণফুলী টানেল যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে ২০২২ সালের মধ্যেই। রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেয়ার আশা সরকারের।
শিক্ষায় অগ্রগতি : শিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে শুরু হওয়া উন্নয়নের ঝাণ্ডা এখন বয়ে নিয়ে চলেছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তি, বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে নতুন বই আর শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা এখন বিশে^র কাছে উদাহরণ। তবে চ্যালেঞ্জও আছে বেশ কিছু। এদিকে উচ্চশিক্ষা ছড়িয়ে দিতে একের পর এক বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। বেড়েছে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যাও। তবে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, শিক্ষানীতির পুরো বাস্তবায়ন না হওয়া এবং শিক্ষা আইন তৈরিতে দেরি হওয়া দেশের শিক্ষাকে বিশ^মানে উন্নীত করার পথে বাধা হয়ে আছে।
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ভিত রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু। শিক্ষা ব্যবস্থাকে শুধু পুনর্গঠিত নয়, একটা দর্শন দিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা কাঠামো ও মাধ্যমিক শিক্ষা কাঠামো ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল এবং কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে এটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সব কিছু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের কল্যাণে করা হয়েছে। শিক্ষাকে আনন্দের উপকরণে রূপান্তরিত করা এবং শিশুদের পরীক্ষাভীতি থেকে মুক্ত করা হচ্ছে।
উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ : গ্রামাঞ্চলে এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। বার্ষিক মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, প্রস্তুতি চলছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের। উন্নয়নের রোড ম্যাপ ধরে নির্মিত হচ্ছে পায়রা সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল। বিশে^ গুরুত্বের সঙ্গে প্রশংসিত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মানবিক দিক। এছাড়া গণতন্ত্রের প্রশ্ন, অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রশ্ন এবং ভ‚রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অবস্থানের প্রশ্ন- এই তিনটি বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে। অন্যদিকে গত ৫ দশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দেয়া, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উঠে আসা, শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যাপক অংশগ্রহণ ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে। জঙ্গীবাদ দমনে সাফল্যের দিকটিও প্রশংসা পেয়েছে। মাথাপিছু গড় আয় ও আয়ু, নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে কৃষি খাতে। করোনার দুঃসময়ে আমাদের রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বেড়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও বেড়েছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যানের মাধ্যমে উন্নয়নকে একই ছাতার নিচে এনেছে সরকার। কোভিডের ধকল কাটিয়েও উন্নয়নে সরকার বদ্ধপরিকর।
যেতে হবে বহুদূর : বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫০ বছরে অর্জন অনেক, তবে ব্যর্থতাও কম নয়। জাতির পিতাকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। জিয়া এবং এরশাদ বারবার সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে পাকিস্তানি ভাবধারায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, গত ৫০ বছরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার শুরু এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়া সবচেয়ে বড় অর্জন। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনাই আমাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে কেনা সংবিধানের মূল চেতনা ফেরত আনা জরুরি। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এটিই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বাংলাদেশের অভ‚তপূর্ব উন্নয়নের প্রশংসা বিশ্বজুড়ে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই ২০৪১ সালের আগেই উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সরকার।