রঙিন সাজে সেজেছিল পুরো হাতিরঝিল, ছিল উৎসবের আমেজ। তবে চারদিকে ছিল নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা টিকে রইল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকা ম্যারাথন শেষ না হওয়া অবধি। সবকিছু হলো ঠিকঠাক, তাতে সফল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এবং তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘বিশেষ’ এই আয়োজন।
সতর্কতার সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকে, উৎসবের আমেজে রোববার সকাল ৬টায় বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে উদ্বোধন হয় বঙ্গবন্ধু ঢাকা ম্যারাথনের। ২০০ দৌড়বিদের অংশ নেওয়া আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতার শুভ উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে এ সময় উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। উদ্বোধনের আধঘণ্টা পরই ট্র্যাকে নামেন অ্যাথলেটরা এবং শুরু হয় বঙ্গবন্ধু ম্যারাথন, যা করোনা মহামারিতে, বিশেষত নতুন বছরে বিশে^র বড় ক্রীড়া ইভেন্ট। যেমনটা উদ্বোধনী বক্তৃতায় মনে করিয়ে দিতে ভুল করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ‘সারা পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধু ম্যারাথন ২০২১ সালের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া অনুষ্ঠান। ক্রীড়া ক্ষেত্রে এই ইভেন্ট একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে।’
প্রাণপ্রিয় নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বিশেষ এই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে তিন ক্যাটাগরিতেÑ ফুল, হাফ ও ডিজিটাল ম্যারাথন। ফুল ম্যারাথনে দেশি-বিদেশি ১০০ অ্যাথলেটকে ছুটতে হয়েছে ৪২.১৯৫ কিলোমিটার : আর্মি স্টেডিয়াম থেকে শুরু হয়ে বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, গুলশান-২, গুলশান-১ ঘুরে হাতিরঝিলে প্রবেশ করে রাজধানীর নিরিবিলি এবং সুসজ্জিত হাতিরঝিলে দিতে হয়েছে পাঁচ চক্কর। একই পয়েন্ট থেকে শুরু হওয়া হাফ ম্যারাথনে (২১.০৯৭ কিলোমিটার) ১০০ ক্রীড়াবিদ গোটা হাতিরঝিল ঘুরেছে দুবার। আর ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ডিজিটাল ম্যারাথনে আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত সুবিধাজনক স্থানে ৫ কিলোমিটার দৌড়াবে দেশ-বিদেশের নিবন্ধন করা অ্যাথলেটরা।
প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন দেশ-বিদেশের দৌড়বিদরা। মরক্কো, কেনিয়া, ইউক্রেন, ফ্রান্স, বেলারুশ, ভারত, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা দৌড়েছেন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে। এই প্রতিযোগিতা উপলক্ষে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল হাতিরঝিলে। এতে কিছুটা ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে কর্মজীবীদের। তবে কর্তৃপক্ষ আগেই জানান দিয়েছিল, ম্যারাথনের শুরু এবং শেষ হওয়া অবধি হাতিরঝিলে প্রবেশে থাকবে বিধি-নিষেধ। এরপরও আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতার চাক্ষুস সাক্ষী হতে উৎসাহের কমতি ছিল না জনসাধারণের মধ্যে। হাতিরঝিলের প্রতিটি সংযোগস্থলে ছিল উপচেপড়া ভিড়, যা সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
সব ছাপিয়ে স্বস্তি অসাধারণ আয়োজনের সফল সমাপ্তিতে। যেখানে ফুল ম্যারাথনে এলিট দৌড়বিদদের মধ্যে পুরুষ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন মরক্কোর হিসাম লাকুজি, ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছেন যথাক্রমে মরক্কোর আজিজ লামবাভি (২ ঘণ্টা ১০ মিনিট ৫১ সেকেন্ড) ও কেনিয়ার জ্যাকব কিভেট (২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড)। একই ক্যাটাগরিতে মহিলা বিভাগে ২ ঘণ্টা ২৯ মিনিট ৪ সেকেন্ডে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন কেনিয়ার এঞ্জেলা জেম অ্যাসুনদে। ২ ঘণ্টা ৩২ মিনিট ৩১ সেকেন্ডে ইথিওপিয়ার ফান্তু এথিসা জিম্মা দ্বিতীয় এবং ২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে একই দেশের তাহিত এসেতু দিগাফফা হয়েছেন তৃতীয়।
ফুল ম্যারাথনে সার্কভুক্ত দেশগুলোর দৌড়বিদদের মধ্যে পুরুষ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন ভারতের বাহাদুর সিং। তার লেগেছে ২ ঘণ্টা ১১ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড। মহিলা বিভাগে সেরা হন নেপালের পুষ্পা ভান্ডারি, ২ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে। হাফ ম্যারাথনে এলিট দৌড়বিদদের মধ্যে পুরুষ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন কেনিয়ার এডুইন কিপ্রোপ (১ ঘণ্টা ৪ মিনিট ১১ সেকেন্ড) এবং মহিলা বিভাগে প্রথম হয়েছেন কেনিয়ার নাওম জেবেত (১ ঘণ্টা ১৪ মিনিট ৪২ সেকেন্ড)। বাংলাদেশি রানার্স বিভাগে ছেলেদের মধ্যে সেরা হন ফারদিন মিয়া (২ ঘণ্টা ৯ মিনিট ২ সেকেন্ড), দ্বিতীয় কামরুল হাসান (২ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড) ও তৃতীয় ফিরোজ খান (২ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড)।
হাফ ম্যারাথন বাংলাদেশি রানার ইভেন্টে সেরা তিনজন হলেনÑ মো. সোহেল রানা (১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ১৬ সেকেন্ড), ইলাহি সর্দার (১ ঘণ্টা ১৬ মিনিট ২০ সেকেন্ড) ও আল আমিন (১ ঘণ্টা ১৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ড)। একই ক্যাটাগরিতে মেয়েদের বিভাগে সেরা হয়েছেন পাপিয়া খাতুন। তার লেগেছে ১ ঘণ্টা ৪২ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড। দ্বিতীয় হওয়া সুমি আক্তার নির্ধারিত দূরত্ব পাড়ি দিয়েছেন ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট ২ সেকেন্ডে এবং তৃতীয় হয়েছেন সারওয়াত পারভিন, ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে। এদিন বেলা ১১টার দিকে হাতিরঝিলের এম্ফিথিয়েটারে সমাপনী অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
সেনাবাহিনী প্রধান সমাপনী বক্তব্যের শুরুতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। একই সঙ্গে, করোনা মহামারির মধ্যেও বঙ্গবন্ধু ম্যারাথন আয়োজন এবং দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি প্রতিবছর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বঙ্গবন্ধু ম্যারাথন আয়োজনের ব্যাপারেও দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন জেনারেল আজিজ আহমেদ। সবশেষ তিনি ধন্যবাদ জানান প্রতিযোগিতায় সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে।